যোগ্য স্ত্রী ( সংসার চালানোর জন্য শুধু স্বামীরা কেন স্ত্রী রাও রোজগার করে স্বামীর পাশে দাঁড়াতে পারে)

 

Worthy wife

ছবি : সংগৃহীত

যোগ্য স্ত্রী 


সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি  পাঁচ - ছয় ব্যাচ পড়িয়ে লাস্ট ব্যাচ টা পড়াতে এসেছে পাড়ারই ক্লাব টায়। এখানে অয়ন অর্থিকদিক থেকে পিছিয়ে পড়া ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দের পড়ায়। এই ব্যাচ টা পড়ানো হয়ে গেলেই অয়ন এর সাথে প্রায় প্রতিদিনই স্বর্ণালী দেখা করতে আসে। মাঝে মাঝে পড়ানোর সময় চলে আসলে অয়ন এর সাথে স্বর্ণালী ও পড়ায়। খুদে খুদে ছাত্র- ছাত্রী রাও জানে স্বর্ণালী হলো অয়ন এর হবু বউ। আসলে এখনকার বাচ্ছা দের কিছুই শেখাতে হয় না। ওরা বুঝে যায়। অয়ন কে যেমন ওরা স্যার হিসাবে খুব ভালোবাসে , তেমন স্বর্ণালী কেও ওরা দিদি .... দিদি বলতে অজ্ঞান। 


অয়ন আর স্বর্ণালীর সম্পর্কটা সেই স্কুল লাইফ থেকেই। খুব ভালো বন্ধু ছিল দুজনে। স্বর্ণালী অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ে। অন্যদিকে অয়ন দের অবস্থা একদমই ভালো নয়। তবে একসময় ওদের ও অবস্থা মন্দ ছিল না। পাড়ার মোড়ে অয়ন এর বাবার ছিল মুদি খানা দোকান। চালুও ছিল খুব। একদিন হঠাৎই স্টোক হয়ে মারা যায় অয়ন এর বাবা। অয়ন তখন খুবই ছোট। মাত্র দশ বছর বয়স। ক্লাস ফোরে পড়ে। অয়নের বেশ মনে পড়ে সেইদিন টার কথা। সেই দিন ছিল ভাদু মেলার পরব। অয়নের বাবা অয়নকে বলেছিল আজ স্কুল থেকে ফিরে বিকেল বেলা মেলা দেখাতে নিয়ে যাবে। অয়ন এর তো বেশ আনন্দ। স্কুল যাওয়ার পথে স্বর্ণালীর সাথে দেখা হতেই অয়ন বলল - ওই জানিস, আজ আমাদের পাড়ায় ভাদু মেলা হবে। কত কি বিক্রি হবে জিলিপি, বাদাম ভাজা, পাঁপড়, খেলনা। আমায় আমার বাবা বলেছে স্কুল থেকে ফিরলে নিয়ে যাবে। কি মজাই না হবে। খেলনার দোকান, নাগরদোলা আরো কত কি আছে। স্বর্ণালী অবাক চোখে অয়ন এর দিকে তাকিয়ে থাকলো। চোখ বড় বড় করে স্বর্ণালী জিজ্ঞাসা করলো আর কাচের চুড়ি! টিপ! মাথার ফুল ......এই গুলো পাওয়া যাবে? অয়ন মস্ত বড় ঘাড় নাড়িয়ে বলেছিল হ্যা পাওয়া যাবে। তাহলে ঐ মেলায় আমিও যাবো। বেশ তো তাহলে স্কুল থেকে ফিরে মেলায় গিয়ে দুজন এর দেখা হবে। দুই বন্ধুতে মহা খুশিতে স্কুলে গেল। বাড়ির ফেরার সময় অয়ন এর উৎসাহ যেন শত গুন বেড়ে গিয়েছিল। স্কুল ছুটির ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে অয়ন এক ছুট্টে বাড়ি এসেছিল। কিন্তু বাড়ির সদর দরজার সামনে এত ভিড় দেখে অয়ন থমকে যায়। ভয় পেয়ে যায়। গুটি গুটি পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখে তার বাবার নিথর দেহ  টা বারান্দায় শোয়ানো। অয়ন এর মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। খুব অল্প বয়সেই স্টোক হয়ে অয়ন এর বাবা মারা যান। 


এরপর থেকে অয়ন এর মা নিজেই সংসারের যাবতীয় হাল সামলায়। মুদির দোকান টাও উনি ই দেখতেন। এইভাবে পুরোপুরি মায়ের সাহায্য তেই অয়ন বড় হয়ে ওঠে। তবে অয়ন এর বাবা মারা যাওয়ার পর অয়ন দের মুদি খানা দোকান আর আগের মতো চলতো না। স্কুল লাইফের প্রায় শেষের দিকে স্বর্ণালী একদিন অয়ন কে প্রপোজ করে। অয়ন ও স্বর্ণালী কে খুব ভালোবাসতো মনে মনে। কিন্তু স্বর্ণালীরা যেহেতু অনেক বড়লোক তাই বলতে সাহস হয় নি। স্বর্ণালী অয়নের সব পারিবারিক অবস্থা জেনেও ওকে ভালোবাসতো। 


কলেজ শেষ হওয়ার পরে অয়ন একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অন্য দিকে পাড়ায় ঝা চকচকে অনেক মল গড়ে ওঠায় অয়ন দের দোকান টা বিশেষ চলতো না। আর অয়নের মা এরও বয়স হয়েছিল। তাই অয়ন বাধ্য হয়ে দোকানটা বিক্রি করে দেয়। কিন্তু মন্দার বাজারে এম. এ পাশ ছেলের চাকরি জটানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তাই অয়ন টিউশন পড়াতে থাকলো। আর বাড়তি সময় সরকারি চাকরির জন্য পড়তে থাকলো। অন্যদিকে স্বর্ণালী র সঙ্গে অয়ন এর ভালোবাসা টা চলছিলই। অয়ন যেহেতু ভালো টিউশন পড়ায় নানা জায়গা থেকে তার ডাক আসতে থাকলো। বিভিন্ন এলাকায় ও ব্যাচ খুলে টিউশন পড়ানো শুরু করলো। ও টিউশন  টাকেই পেশা করে নিয়েছিল। বেশ ভালোই চলছিল। এই টিউশন এর জন্যই ও সরকারি চাকরির জন্য আর পড়ার সুযোগ পেল না। অন্যদিকে স্বর্ণালী একটি সরকারি স্কুলে চাকরি পেয়ে গেল। ওর বাড়ি থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকলো। বাধ্য হয়েই একদিন স্বর্ণালী সব ছেড়ে অয়ন এর কাছে চলে এলো। কিন্তু অয়ন বললো দেখো স্বর্ণালী আমি পাড়ায় পাড়ায় টিউশন পরিয়ে যে টাকা পাই তাতে কি তোমার মা, বাবা আমার সাথে তোমার বিয়ে দেবেন? তার থেকে তুমি তাদের পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করো। আমি বলছি তুমি সুখী হবে।কথাটা বলতে গিয়ে অয়নের বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। তাও অয়ন স্বর্ণালীর ভালোর কথা ভেবেই বললো। ছেড়ে চলে যাব বলে তো তোমায় ভালোবাসিনি অয়ন। আমি তোমার কাছে সুখেই থাকবো। আর কে বলেছে তুমি ভালো রোজগার করো না? তুমি নিজের হাতে কত ছোট ছোট খুদে দের ভবিষৎ করে তুলছ বলতো এটাই কম কিসের ? তবু অয়ন দুই বাড়ির মত ছাড়া বিয়ে করতে রাজি হয় নি। 

 শেষ পর্যন্ত দুই পরিবারের মতেই ওদের বিয়ে হয়। স্বর্ণালীর বাবা বড়লোক হলেও, খাঁটি মানুষ চিনতে ভুল করেন নি। তিনি বুঝেছিলেন অয়ন গরিব হতে পারে। কিন্তু লোভি নয়। পরিশ্রমী। আসলে কিছু কিছু ভালোবাসা ছেড়ে যাওয়ার জন্য আসে না। সমস্ত বাধা, বিগ্নতা সত্ত্বেও থেকেই যায়।

বিয়ের পর একদিন অয়ন টিউশন পরিয়ে ফিরছিল। কয়েকজন লোক পাড়ার মোড়ে চা খাচ্ছিল। অয়নকে দেখে টোন টিক্কিরি কাটলো - ওই যে যাচ্ছে ভেড়া। বউ দিদিমণি গিরি করে সরকারি স্কুলে। আর ও বউ এর ঘাড়ে বসে খায়। অয়নের খুব খারাপ লাগলো শুনে। বাড়ি ফিরে স্বর্ণালীকে বললো, তোমায় আর চাকরিটা করতে হবে না স্বর্ণালী। স্বর্ণালী অবাক হয়ে বলল কেন? অয়ন বললো রাস্তায় ওর সাথে ঘটে যাওয়া টোন টিটকিরির কথা। স্বর্ণালী বললো ওদের কথা বাদ দাও। বর যদি তার রোজগারের পয়সায় বউ কে খাওয়াতে পারে, তাহলে বউ কেন পারবে না তার স্বামীর সুখে দুঃখে তার পাশে দাঁড়াতে? ছেলে মেয়ে উভয়কেই স্বাবলম্বী  হওয়া উচিত। আর তুমি তো টিউশন পড়িয়ে রোজগার করই। তোমার এত হীনমন্যতায় ভোগার কি আছে? সরকারি চাকরি মানেই সেটা রোজগার আর পরিশ্রম করে রোজগার করাটা কি রোজগার নয়? আসলে ওরা তোমায় কমজুরি করার জন্য তোমার কানের কাছে ওইসব বলছে। ওদের কাজ নেই। তাই লোকের কান ভাঙাতে চায়।  ওদের কথায় কান দিও না অয়ন। দুনিয়া এখন বদলে গেছে। এখন স্ত্রী রাও রোজগার করে স্বামীর সুখ দুঃখ এ পাশে দাঁড়াচ্ছে। ভালোবাসা থাকলে সব সম্ভব। আর আমরা ভালোবাসা , বিশ্বাস দিয়েই আমাদের সুখ দুঃখের সাম্রাজ্য গড়ে তুলব দুজনে একটু একটু করে। অয়ন জড়িয়ে ধরলো স্বর্ণালীকে। অয়নের মা ঘর থেকে ওদের কথা শুনে অয়নের বাবার ছবির কাছে বসে বিড়বিড় করে বললেন, এ সংসারে যোগ্য বৌমা এসে গেছে গো। আমার ঘর আলো করে  দশভূজা এসে গেছে।


সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ