তপ্ত পড়ন্ত দুপুরের তীক্ষ্ণ সূর্যের তেজটা তখন প্রখর। ঘড়িতে প্রায় সোয়া তিনটে বাজবে। রুপোলি পার্কের সামনে শোভন এসে দাঁড়ালো। ভিড় বাস থেকে নেমেছে। ঘর্মাক্ত শরীর । মনে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে ধীর গতিতে পার্কে ভিতরে ঢুকলো। সেই অতি চেনা বসার সিটটার সামনে গিয়ে ও একবার থমকে দাঁড়ালো। মনে মনে একটু হাসলো। গিয়ে ওখানেই বসলো। এই সিট টা শোভনের জীবনের অনেকটা ভালোলাগা দখল করে আছে। ও যখন এসে দেখলো আজও সিট টায় এখনো পর্যন্ত কোনো প্রেমিক প্রেমিকা বসে নি, সিট টা খালি আছে ওর মনে হলো সিটটাও হয়তো মৌ এর মত তাকে নিয়ে ছলনা করছে। তাই সিট টা দেখে ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে হাসলো শোভন।
মৌ কে অনেকবার অনুরোধ করার পর দীর্ঘ দু মাস পর ও দেখা করতে রাজি হয়েছে। মৌ এর দিক থেকে সব টুকু সম্পর্কই শেষ হয়ে গেছে। তবু শোভন এর মন মানে নি। দীর্ঘ তিন বছরের ভালোলাগা, ভালোবাসা, অভ্যাস টাকে ও কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিল না। স্মৃতি গুলো ভিড় করে ওর বুকের পাঁজর টাকে যেন টুকরো টুকরো করে দিচ্ছিল। সাজানো স্বপ্ন গুলো তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কেন ? তার কোনো উত্তর শোভন মৌ এর কাছ থেকে পায় নি। গত দু মাস ধরে মৌ শোভন এর কোনো ফোন ধরছে না। মেসেজ সিন করছে না। শোভন কে ফেসবুকে ব্লক পর্যন্ত করে দিয়েছে। কোনো ভাবেই মৌ এর সাথে যোগাযোগ না করতে পেরে শোভন হাপিয়ে উঠেছিল। এই দুমাসে কত রাত যে শোভন না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে মৌ এর একটা কল এর আশায় । একটা মেসেজ এর আশায়। জেগে জেগে থাকতে থাকতে চোখ লেগে গেলেও দুঃস্বপ্নে ওর ঘুম ভেঙে যেত। চোখ মিলেই প্রথমেই ও ফোন চেক করত যদি অন্তত একটা মেসেজ মৌ করে। কিন্তু না। এই কয়েকদিনে একটা মেসেজ ও মৌ এর নম্বর থেকে আসে নি। বার বার ফোনকরাতে অনেক কাকুতি মিনতি করাতে আজ মৌ দেখা করবে বলেছে ।বিকেল চারটা তে। রুপোলি পার্কে। এই পার্কেই ওরা দেখা করতে আসতো প্রতি সপ্তাহে। কিন্তু আজ শোভন আধ ঘন্টা আগেই চলে এসেছে। সিট টায় বসে মৌ এর জন্যই শোভন অপেক্ষা করছিল।
- কি বলবে বলো ? কেন বার বার ফোন করে মেসেজ করে আমায় ডিস্টার্ব করছো তুমি? আমি তো তোমায় বলেই দিয়েছি আমার পক্ষে এই সম্পর্ক টা রাখা আর সম্ভব নয়।
মৌ কে অনেকদিন পর দেখে শোভন কিছুক্ষণ মৌ এর দিকেই তাকিয়ে রইলো। মৌ এর এই কথা গুলো এর আগে অনেকবার শুনেছে। কিন্তু কেন সম্পর্ক টাকে ও আর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে না সেটা শোভন জানে না।
- কি হলো ন্যাকার মতো কি দেখছো? যা বলার তাড়াতাড়ি বলো । আর হ্যা আজকের পর থেকে আমায় আর ডিস্টার্ব করবে না।
- তোমার আমায় মনে হলো এত দূর থেকে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি আমি ন্যাকামি করার জন্য মৌ? তুমি আমার সাথে এইরকম ব্যবহার কেন করছো?
...........…...........................
গল্পের নায়িকা মৌ। মৌ কলকাতায় থাকে। বাবা , মায়ের একমাত্র সন্তান। ওর বাবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। অন্য দিকে গল্পের নায়ক শোভন। কলকাতা থেকে একটু দূরে একটি গ্রামে থাকে। শোভন রা নিম্নমধ্যবিত্ত। বাবা একটি কারখানা য় কাজ করেন। মৌ এর সাথে শোভন এর পরিচয় কিভাবে হয়েছিল জেনে নেওয়া যাক।
সেইসময় টা ছিল শীতকাল। দুপুরের দিকে শোভন কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্যেশে যাওয়ার জন্য বাসে উঠেছিল। ও কলকাতারই একটি কলেজে পরে। এখানেই একটি মেসে থাকে। তবে সেইদিন সে বাড়ি ফিরছিল। কারণ বেশ কয়েকদিন ধরেই ওর শরীর টা ভালো ছিল না। জ্বর আসছিল। সাথে তীব্র মাথা যন্ত্রনা। তাই আজকের ক্লাসটা কোনো মতে করেই ও বাড়ি ফিরছিল। বাসের ভিতরে ঢুকতেই ও প্রথম সিটে এই জানালার ধারে বসার জায়গা পেয়ে যায়। এই জন্য সে ভগবান কে অশেষ ধন্যবাদ জানায়। এরপর ও কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে শুনতে ঘুমোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই তার এই ভাগ্য টা বদলে যায়। হটাৎ একটা ঠেলা পেয়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। শোভন চোখ খুলে দেখে জিন্স, টপ পরিহিতা একটি মেয়ে তাকে কিছু বলতে চাইছে। কানে হেডফোন থাকায় ও কিছুই শুনতে পায় নি এতক্ষন। কান থেকে এবার হেডফোনটা খুলে ও বলে
- কিছু বলছেন নাকি ?
- বলছিলাম আমার না শরীর টা খুব খারাপ। ভীষণ গা গুলোচ্ছে। যদি দয়া করে আমায় জানালার ধারের সিটটা দেওয়া হয়, তাহলে খুব ভালো হয়।
শোভন একবার এই দিক ঐদিক তাকিয়ে দেখল তারপর কিছু না বলে উঠে গিয়ে মেয়েটিকে জায়গা ছেড়ে দিল।
শোভন বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো কপাল যত টা ভালো ভেবেছিলাম ততোটাও ভালো না। এ যে দেখছি পোড়া কপাল আমার। কিন্তু বাস চলার কিছুক্ষন পর থেকেই শোভন এর শরীর টা খারাপ হতে শুরু করলো। যেন ও এর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। নিজেই নিজের কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর এসে গেছে। সাথে অসহ্য গা- হাত -পায়ে যন্ত্রনা। এই ভাবেই কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ও যেন ঝাপসা দেখতে লাগলো সব কিছু । একসময় মাথা ঘুরে পরে গেল। সবাই হই হই করে উঠলো। বাস দাঁড়িয়ে পড়লো। পুলিশ কেস হয়ে যাওয়ার ভয়ে কিন্তু কেউ সাহায্য করতে এলো না। শেষপর্যন্ত বাসের সিট ছেড়ে দেওয়া মেয়েটি এম্বুলেন্স কে ফোন করে কাছাকাছি নার্সিং হোমে শোভন কে নিয়ে যায়। কিছুক্ষন সেলাইন, ইনজেকশন দেওয়ার পর শোভন এর জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরতে শোভন দেখে ও নার্সিংহোমের বেড এ শুয়ে আছে। ওর কিছুই মনে পড়ে না। ডক্টর বাবু বলেন এখন আপনি ঠিক আছেন। আপনাকে যিনি ভর্তি করিয়েছেন তাঁকে ডেকে দিচ্ছি। শোভন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে আর ভাবে কে তাকে এখানে নিয়ে এলো। কিছুক্ষন পরেই ও দেখলো সেই মেয়েটি । যাকে ও দুপুর বেলা বাসে জানালার পাশের সিট টা দিয়েছিল।
- এখন কেমন আছেন?
- বেশ ভালো। আমাকে ভর্তি করানোর জন্য ধন্যবাদ।
- ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে ছোট করবেন না প্লিজ। আসলে আমার জন্যই তো আপনার এইরকম হলো। আপনি যদি সিট টা আমায় না ছেড়ে দিতেন তাহলে এই প্রবলেম টা হত না।
- না না। সেইরকম কোনো ব্যাপার না। আসলে আমার বেশ কয়েকদিন ধরেই শরীর টা খুব খারাপ যাচ্ছিল। জ্বর হচ্ছিল। আজ বাড়ি ফিরছিলাম।
- ও সরি! সত্যি কথা বলতে কি আমার তখন গা গুলোয় নি। জানালার ধারের সিট টা নেওয়ার জন্য ঐরকম বলেছিলাম। আমি খুবই দুঃখিত। আমার জন্য আপনাকে এত কষ্ট পেতে হলো।
- আচ্ছা ঠিক আছে। তেমন কিছু ব্যাপার না।
- আচ্ছা, আপনার ফোন নম্বর টা নেওয়া যাবে? আসলে ডক্টর বললেন আপনার আর তেমন কিছু প্রবলেম নেই। ঠিক হয়ে যাবেন। ওরা এখনি আপনাকে ছাড়বে না। কিছুক্ষন পর ছাড়বে। আমি তো এবার বাড়ি চলে যাব। যাতে আপনি ঠিক মতো পৌঁছলেন কিনা জানার জন্য ফোন নম্বর টা চাইছিলাম।
একটা মেয়ে যেচে তার থেকে নম্বর চাইছে। শোভন কি করবে ভেবে পেল না প্রথমে। একটু ইতস্তত বোধ করছিল। যখন মেয়েটি বলল, আচ্ছা অচেনা কাউকে নম্বর দিতে যখন এতই ভয় তখন আগে আলাপ টা করে চিনে নিন। আমি মৌ। আমি কলেজ এ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
শোভন ও ওর নাম টা বললো। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর শোভন মৌ কে নম্বর টা দিল।
বাড়ি ফিরে শোভন বাড়িতে এইসব কোনো কথাই বললো না। স্নান সেরে খেয়ে নিয়ে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় শোভন এর ফোন টা বেজে উঠলো।
- হ্যালো, কে বলছেন?
- হ্যালো আমি মৌ বলছি। আপনি এখন কেমন আছেন?
- এখন মোটামুটি ভালোই আছি।
- আচ্ছা। কি করছেন?
- এই তো খেয়ে নিয়ে এবার একটু রেস্ট করবো বলে বিছানায় এলাম।
- আচ্ছা ঠিক আছে। রেস্ট নিন। আমি পরে আপনাকে ফোন করবো।
তারপর মৌ আর শোভনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হলো। ওরা সবসময়ই একে অপরকে ফোন করতো। একে অপরের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারলো। দিন এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু একদিন মৌ প্রপোজ করলো শোভন কে। শোভন কখনোই মৌ কে প্রেমিকা হিসাবে মানতে পারছিল না। সে বলল মৌ কে এ হয় না মৌ। তোমার আর আমার মধ্যে বিস্তর ফারাক। তোমার বাবা বড়লোক। আমরা সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত। তাছাড়া আমরা গ্রামে থাকি। তোমার এই সব মোহ।
- না শোভন। আমি যা বলছি ভেবে চিনতেই বলছি। আমি তোমায় ছাড়া বাঁচবো না শোভন। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।
- কিন্তু আমি চাই না তোমার সাথে এইরকম একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে।
- কিন্তু কেন শোভন? আমি কি দেখতে এতই খারাপ?
- দেখো মৌ ভালোবাসা রূপ দেখে হয় না।
- তাহলে এটাও জেনে রেখো শোভন ভালোবাসা বড়লোক গরিব লোক দেখেও হয় না।
- আমি তোমায় ভালোবাসি। আর আজীবন ভালোবেসে যাবো। তুমি প্লিজ বলো আমায় তুমি ভালোবাসো কিনা। নাহলে কিন্তু আমি তোমার বাড়ি এখনি চলে যাব।
শোভন এই কয়েকদিনে কথা বলে বুঝতে পেরেছিল মৌ খুবই জেদি মেয়ে। তাই শেষ পর্যন্ত শোভন ও মৌ এর ভালোবাসায় ধরা দিল।
ধীরে ধীরে একে অপরের খুব কাছে চলে আসলো তারা। প্রতি সপ্তাহে রুপোলি পার্কে ওরা দেখা করতো। একে অপরকে অন্তর থেকে খুব ভালোবাসতো। এই ভাবেই কেটে গেল তিন তিনটে বছর। ওদের এই ভালোবাসার সম্পর্ক এ তেমন কোনোদিন ঝগড়া অশান্তি হয় নি। কিন্তু গত দুই মাস ধরে মৌ সম্পূর্ণ ভাবে শোভন কে এড়িয়ে চলছিল। শোভন এখন মৌ কে পাগলের মতো ভালোবাসে। ওকে ছাড়া ও কিছু ভাবতেও পারে না। আজ মৌ এর সাথে ও একটা বোঝাপড়া করতে এসেছে। কেন মৌ এই সম্পর্ক টা আর রাখতে চায় না সেটা ও জানতে চায়।
......................................................
- আমি এর আগেও বলেছি শোভন এখনো বলছি প্লিজ আমায় তোমার থেকে মুক্তি দাও। আমি আর তোমার সাথে থাকতে চাই না।
শোভন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। ওর দু চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। দু হাত দিয়ে চোখের জল মুছে,
- আসলে কি বলো তো মৌ, তোমার মত বড়লোক এর আদুরে মেয়ে রা আমাদের মতো সাধারণ ঘরের ছেলেদের নিয়ে মজা করতে ভালোবাসে, তাদের আঘাত দিয়ে নিজে খুশিতে থাকে। আর আমার মতো ছেলেরা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে ঠকে যায়। মনে রেখো মৌ শোভন শুধু তোমাকে ভালোবাসে। আজীবন তোমাকেই ভালোবাসবে।
মৌ আর ওখানে বসে থাকতে পারলো না। উঠে দাঁড়ালো।
- হ্যা, যাও যাও। বড়লোকের ছেলের সাথে মনে হয় দেখাশোনা ঠিক হয়ে গেছে। তাকেই বিয়ে করে সুখে থেকো।
মৌ কাঁদতে কাঁদতে হনহন করে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো। এটাই ছিল শোভন এর সাথে ওর শেষ দেখা। মৌ এর এই কষ্ট টা শোভন জানতে পারলো না। মৌ এর বাবা মৌ এর সাথে শোভন এর সম্পর্কে র কথা জানতে পেরে বলেছিল মৌ যদি ঐ ছেলে কে বিয়ে করে তাহলে উনি সুইসাইড করবেন। জন্মদাতার সন্মান , কথা রাখতে মৌ নিঃশব্দে তার ভালোবাসাকে মেরে ফেলল।
ঐদিকে পার্ক থেকে বেরিয়ে শোভন উদেশ্য হিন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে ওর একটি গাড়ির সাথে ধাক্কা হয়। হাসপাতাল নিয়ে গেলেও তাকে বাঁচানো যায় নি। বাড়ি পৌঁছে টিভিতে এই মৃত্যুসংবাদ শুনে মৌ ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি। দিকবিদিকজ্ঞানহারা হয়ে মৌ ও নিজেকে শেষ করে দেয়।
এই ভাবেই একটি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা চিরতরে হারিয়ে যায়। নিষ্পাপ একটি ভালোবাসো অসমাপ্তই থেকে যায়।
সমাপ্ত
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ