বেশ অনেকগুলো দিন পর নেহা আজ নতুন ভাবে ভোরের সূর্য দেখলো। আজ অনেক ভোর বেলা ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। নিজেকে বেশ ফ্রেশ মনে হচ্ছিল ওর। অনেকটা স্বাধীন মনে হচ্ছিল। বিছানা ছেড়ে নেবে ঘরের বন্ধ জানালা গুলো খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ ঠান্ডা বাতাস ওর মনকে আরো উৎফুল্ল করে তুলল। ও জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চোখ বুজে ওই সব টুকু বাতাস নিজের চোখে, মুখে প্রানভরে মাখতে চাইলো। ওর কোমর ছাপানো চুল গুলো তখন এলোমেলো হয়ে উড়ছে। ও বাধা দিল না। সে গুলো ও উড়তে থাকলো। ভোরের সূর্য তখন সবে পুব আকাশ থেকে উকি দিয়েছে। একটা দুটো পাখির শীষ দেওয়া আওয়াজ শুনে মনে মনে হাসতে থাকলো নেহা। একবার ওদের কণ্ঠস্বর কে নকল করতে চাইল। আবার কি যেন ভেবে ওদের শিস গুলোই পরম মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকলো। অনেক অনেক গুলো দিন পর যে নেহা ভোরের এই সৌন্দর্য উপভোগ করছে। এতদিন এই প্রকৃতির মনোরম সৌন্দর্য্য তা থেকে সে বঞ্চিত ছিল।
.......…..…....................…....................................
নেহা গুপ্তা। বয়স কুড়ি। কলেজ তৃতীয় বর্ষ। বাবা- মায়ের একমাত্র মেয়ে। বাবা, মা দুজনেই সরকারি চাকুরী করেন। মা নার্স। বাবা পুলিশে কর্মরত। দুজন এই নিজেদের কর্মজীবন নিয়ে খুবই ব্যস্ত । কিন্তু তারা দুজনে যত টুকু সময় ই পায় ভাগাভাগি করে নেহাকে তারা টাইম দেওয়ার চেষ্টা করে। নেহাও পড়াশোনায় বরাবরই পড়াশোনায় খুব ভালো। ওর মা, বাবা যখনই সময় পান নেহাকে বাড়িতে পড়াতেন ছোট থেকেই। এছাড়া গৃহশিক্ষিক তো ছিলেনই। তাছাড়া নেহা নাচ, গানে পারদর্শী। নেহার মা শত ব্যস্ততার মাঝেও ওকে ছোটবেলায় নাচের স্কুলে নিয়ে যাওয়া গানের স্কুলে নিয়ে যাওয়া সবটাই একাই সামলেছেন। বড় হতে নেহা বান্ধবীদের সাথেই প্রাইভেট পড়তে যাওয়া, নাচ, গান এর স্কুল এ যেত। আর পাঁচটা সাধরন ছেলে- মেয়ের মতোই নেহা বড় হয়ে উঠছিল। নেহা বেশ দেখতেও সুন্দর। ৫ '৫ হাইট, ছিপছিপে গড়ন, মিষ্টি হাসি, মায়ের মতো ফর্সা ধবধবে, টিকলো নাক, আর ওর চোখ গুলো বেশ মায়াবী। ওর বান্ধবীরা ওকে সবসময়ই বলতো দেখিস নেহা তোর যে বয়ফ্রেন্ড হবে সে সবসময় তোকে চোখে হারাবে। নেহা ওদের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যেত- ধুর তোরা কি যে বলিস? আমি কি দীপিকা নাকি ক্যাটরিনা? আমায় তোরা কি ভাবিস ? আর প্রেম ট্রেম আমার দ্বারা হবে না। আমি এই বেশ ভালো আছি। তোরা তো আছিসই। তাছাড়া পড়াশোনা, নাচ, গান এই সব নিয়েই বেশ ভালো সময় কাটাই। আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড এর দরকার নেই।
- দেখিস দিন - কাল কিন্তু খুব খারাপ। পাছে তুই আবার যাকে বলে ডাক সাইটে সুন্দরী। পাত্র জুটে গেল বলে। ( নেহার বান্ধবী রা বলতো)
ওই দিকে নেহা বড় হওয়ার সাথে সাথে ওর মা বাবার ও চিন্তার শেষ ছিল না। যেমন সব মা বাবা দের ই থাকে আর কি! নেহার বাবা, মা ওর সাথে বন্ধুর মতোই মিশতেন। যাতে কোনো অসুবিধা হলে ও যাতে নির্দ্বিধায় ওদের সাথে শেয়ার করতে পারে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে হয়তো অন্য কিছু লেখা ছিল। তাই নেহার শেষ পরিণতি টা খুবই হৃদয় বিদারক। খুবই কষ্টের।
নেহা মাধ্যমিক দিয়ে যখন ইলেভেন এ উঠলো তখন বাংলা পড়তে যেত একটি স্যারের কাছে। ওখান থেকে আসার পথে ও দেখতো একটি মোবাইল এর দোকান এর ছেলে প্রায়ই ওকে দেখে। প্রথম প্রথম ও ব্যাপার টা খেয়াল করে নি। পড়তে যাওয়া আসার পথে অনেক ছেলে মেয়েরাই ওই দোকানে ফোনে রিচার্জ করতে যেত। একদিন নেহার একটা বান্ধবী প্রীতি ও ওই দোকানে রিচার্জ করতে গিয়েছিল। তখন ঐ মোবাইল এর দোকানের ছেলেটা ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোমার সাথে যে মেয়েটি এসেছে ওর নাম কি কোথায় থাকে। প্রীতি কোনো উত্তর না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সব ঘটনা নেহাকে বলে। তারপর থেকেই নেহা খেয়াল করত বাংলা পড়ে ফেরার পথে ছেলেটা প্রতিদিন ওর দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। ওকে এক ঝলক দেখার জন্য। কিছুদিন এইভাবেই চলার পর এটাই যেন ছেলেটা আর নেহার একটা নেশা হয়ে গেল। দুজন দুজনকে এক ঝলক দেখেই যেন কতটা শান্তি পেত।
একদিন পড়তে থেকে বেরিয়ে নেহা ওই দোকান টার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো দোকানের সামনে ওই ছেলেটা আজ দাঁড়িয়ে নেই। ও বান্ধবী দের সাথে হাটতে হাট তেই উকি দিয়ে এইদিক ঐদিক দেখতে দেখতে সব বান্ধবী দের বিদায় জানিয়ে বাড়ির সামনের গলি দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিল। হটাৎ ই একটি পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে নেহা চমকে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে সেই মোবাইল এর দোকান এর ছেলেটা।
- তোমায় আমি কিছু বলতে চাই নেহা!
- আপনি.... আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?
- সেটা পরের কথা। এখানে সব কথা বলা যাবে না। তুমি আমার সাথে দেখা করতে পারবে?
- কোথায়?
- কাছেই ওই সোনালী পার্কে?
- কবে?
- কাল। ঠিক বিকেল পাঁচটায়।
- আচ্ছা, ঠিক আছে।
এই বলে নেহা এক ছুটতে বাড়ি চলে এসেছিল। সেইদিন ওর সারারাত ঘুম হয় নি। নিজে মনে মনে ভাবছিল ও আমার নাম জেনে গেল। আর ওর নাম টা কি আমার জানা হলো না। ইস! আমি একটা গাধা! যাই হোক পরের দিন নেহা কাউকে না বলে নিজের সব ধারণা ভুল প্রমাণিত করে ওই ছেলেটির ডাকে চলল দেখা করতে।
সেইদিন থেকেই নেহার জীবনটা গেল বদলে। ছেলেটির নাম ছিল প্রতাপ। মোবাইল দোকান এর মালিক ছিল ও। নেহা নিঃস্বার্থ ভাবে প্রতাপ কে ভালো বেসে ছিল। প্রথম দিকে প্রতাপ ও নেহা কে খুব ভালোবাসতো। ওর জন্মদিনে ওকে বাড়ি থেকে নিজে হাতে পায়েস রান্না করে এনে খাওয়াতো। বিরিয়ানি , চিকেন চাপ করে আন্ত। নেহা নিজেকে খুব লাকি মনে করতো। ভাবতো এইরকম বয় ফ্রেন্ড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ওর বান্ধবী রা ঠিক ই বলেছে প্রতাপ ওকে চোখে হারায়। দিন দিন ওদের ঘনিষ্ঠ তা আরো বাড়তে থাকল। নেহা এবার স্কুল কেটেও পার্কে, সিনেমা হলে প্রতাপ এর সাথে দেখা করতে যেত। এই ভাবে কেটে গেল প্রায় দুটো বছর। ওরা প্রায় দিনই সারা রাত ফোনে করত। তাই নেহা ঘুম থেকেও উঠতো প্রায় বেলা করে। এই করে করে ওর উচ্চ মাধ্যমিক এর রেজাল্ট ও খুব খারাপ হলো। ওর বাবা, মা খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লো। তারা নেহার সাথে কথা বলে জানতে পারলো নেহা ভালোবাসে প্রতাপ কে। নেহার বাবা মা যেহেতু ওর সাথে বন্ধুর মতো মিশত তাই ওকে কোনো বকাঝকা করে নি। বরং বলেছিল এখন অল্প বয়স, কলেজ পাশ করে আগে নিজে পায়ে দাঁড়াও তারপর অবশ্যই ওই ছেলের সাথেই তোমায় বিয়ে দেব। এরপর বেশ কয়েকবার প্রতাপ ওদের বাড়ি ওর মা, বাবার সাথে দেখা করে গেছে। নেহার মা, বাবা প্রতাপ এর সাথে খুব ভালো ব্যবহার ই করেছেন।
তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরো তিনটে বছর। নেহা কলেজে পড়ে। এই কয়েক বছরে নেহার মা বাবার অনুপস্থিতিতে প্রতাপ এসেছে অনেকবার ওদের বাড়ি। ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে বেশ কয়েকবার। নেহা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে ওর সর্বস্ব দিয়েছে। কিন্তু ইদানিং নেহা লক্ষ্য করছিল প্রতাপ অনেকটা বদলে গেছে। ওর ফোন রিসিভ করে না। দেখা করতে বললে দেখা করে না। বার বার কল করলে ব্যাক লিস্টে রেখে দেয়। নেহার বন্ধু প্রীতি একদিন এসে নেহা কে বলল, প্রতাপ এর নাকি অন্য কোথাও দেখাশোনা চলছে।
এই কথা শুনে নেহার মাথায় বাজ নেমে পড়ে। ও কাউকে কিছু বলতে পারে না। গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে। বাবা মা কে নিজের ঠকে যাওয়ার কাহিনী সে বলতে পারে নি। অনেক কষ্টে ও একবার প্রতাপ এর সাথে দেখা করার সুযোগ পায়। নেহা সোনালী পার্কেই প্রতাপ কে দেখা করতে বলে। সেইদিন নেহা খুব মানসিক ভাবে শক্ত ছিল।
- প্রতাপ আমি নাকি শুনলাম তোমার অন্য কোথাও দেখাশোনা চলছে?
- কে বলেছে? ( প্রতাপ)
- প্রীতি ( নেহা)
- হ্যা, ও ঠিক ই বলেছে।( প্রতাপ )
প্রতাপ এর মুখে এই কথা শোনার পর নেহার বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও নিজেকে শক্ত করে বলেছিল কেন করলে এমনটা?
- তোমায় আর পছন্দ নয় তাই।
নেহা এর কোনো কারণ জানতে চায় নি। ওইটুকু শুনেই বেরিয়ে এসেছিল সেইদিন। নিজেকে আবার সুন্দর করে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
তাই তো আজ ভোর টা তার কাছে ছিল একটা নতুন যুগের সূচনা। সব কিছু ভুলে নতুন ভাবে ও নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে চেয়েছিল।
কিন্তু দুপুরের দিকে হটাৎ প্রতাপ এর ফোন আসায় নেহা বেশ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে।
- নেহা তোমার সব অশালীন ফটো আর ভিডিও আমি আমার কাছে রেখে দিয়েছি। যদি চাও ওগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় না ছড়িয়ে যাক তাহলে কালকের মধ্যে আমি কুড়ি লাখ টাকা তোমায় দিতে হবে।
এই টুকু বলেই ফোন কেটে দেয় প্রতাপ।
তৎক্ষনাৎ ফুলের মতো সাজানো সকাল টা কাটায় বিষিয়ে যায়। নেহা বন্ধুর মতো মা বাবা কেও লজ্জায় এইসব সমস্যা র কথা তাদের বলতে পারে নি। মনের দুঃখ, কষ্ট গুলো শেয়ার করতে পারে নি বান্ধবী দের ও । অকালেই চলে গেল নেহা। কালকের জন্য আর প্রতাপ কে অপেক্ষা করতে হলো না। ঝরে গেল একটি নিষ্পাপ প্রাণ। সন্তান হারা হলো নেহার বাবা- মা। অন্ধ প্রেম শেষ করে দিল একটি প্রাণ কে। একটি পরিবারকে।
সমাপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ