অকৃতজ্ঞ পর্ব - ৮

 ungrateful part 8

আগের পর্ব পড়ুন 

অকৃতজ্ঞ পর্ব - ৮


আজ এই রকম ঝামেলার চোটে নিশাকে ফোন করতে নীল একদম ভুলে গিয়েছিল। কি করবে ভেবে  না পেয়ে নীল বড়ই অস্থির হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি অসহ্য গরমে ও ঘামতেও শুরু করেছে। বার বার মোবাইলের স্কিন এর দিকে চোখ পড়লেই নীল বড় অসহায় বোধ করছে। মোবাইল এর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। এমনিতেও এই সময় টা অফিস টাইম। তাই রাস্তায় যান- জোট ও প্রচুর। নীল খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। ফোন টা বাজতেই নীল স্কিনের দিকে না তাকিয়েই রিসিভ করে নিলো। 

ও প্রান্ত থেকে নিশার উদ্বেগ জনক গলার শব্দ পেয়ে নীল স্তম্ভিত হয়ে গেল। কি বলবে ভেবে পেলো না। ফোন টা কেটে দিতেও ইচ্ছা করল না। এইদিকে ট্রাফিক এ গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেছে। এমনই সময় ড্রাইভার প্রায় জোর গলাতেই একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো, উফফ! এই সময় টা এত জাম হয় দাদা, কি বলবো। 

ড্রাইভারের গলা পেয়ে ওপ্রান্ত থেকে নিশা বললো, নীল তুমি আজ কে এখনো অফিস পৌঁছাতে পারো নি? গাড়িতে আছো? 

- হ্যা... মানে ওই ট্রাফিকে আটকে আছি।

- কখন থেকে ফোন করছিলাম তোমায়। ফোন ধরছিলে না কেন? 

- বুঝতে পারি নি নিশা। 

- শোনো না, আমার আজ ভীষণ মুড অফ...

এখন নিশার সাথে ফোনে গল্প করার মোটেও ইচ্ছা হচ্ছিল না নীলের। কিন্তু নিশাকে কারণে অকারণে আঘাত দিতেও নীল এর মনে বাঁধলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করলো, কেন মুড অফ শুনি?  এখন তো তোমার বোন আছে। তুমি ওর সাথে গল্প করো, সময় কাটাও ।

- ওকে নিয়েই তো প্রবলেম।

- প্রবলেম? কি প্রবলেম? 

ইতিমধ্যে ই গাড়ি চলতে শুরু করেছে। গাড়ি শহরের কোলাহল পূর্ণ রাস্তা ছেড়ে এখন দ্রুত গতিতে ছুটছে। ফুরফুরে হওয়া তে নীল এর মাথার সব চাপ গুলো আস্তে আস্তে কমতে থাকলো। 

ওপ্রান্ত থেকে খানিকটা অভিমানি সুর ভেসে এলো, দেখো না নীল, ঊষা এক একাই শপিং করতে বেরিয়ে পড়ল। আমায় নিয়ে গেল না। কত করে বললাম ওকে...

- ঊষা শপিং মলে গেল? হটাৎ শপিং মলে কেন  গেল? এখান কার রাস্তা ঘাট ও কি সব চেনে নাকি? ওকে তুমি একা একা ছেড়ে ঠিক কর নি নিশা। 

-  আমি অনেকবার বারণ করেছিলাম। কিন্তু ওর যখন যেটা জেদ চাপবে ও তাই করবে। ছোট থেকেই ও এইরকমই। 

- ও...আচ্ছা। তুমি যাও নি ভালোই করেছো। এই সময় কেউ কোথাও ঘোরাঘুরি করে না নিশা। মন খারাপ করে না নিশা। আচ্ছা ঠিক আছে, উইকেন্ডে আমি তোমায় নিয়ে যাবো শপিং করাতে। আমাদের হবু সন্তানের জন্য কিছু ড্রেস কিনবে ।

এক গাল হেসে নিশা বললো, সত্যি বলছো নীল? 

- হমম , সত্যি।

- প্রমিস করো। 

নিশাকে খুশি করতে পেরে তৃপ্তির হাসি হেসে নীল বললো প্রমিস। আচ্ছা নিশা , আমি অফিসের সামনে চলে এসেছি। এখন ফোন রাখছি। নিজের যত্ন নিও। লাভ ইউ।

- ওকে স্যার। লাভ ইউ। 

ফোন কেটে দিলো নিশা। ফোন টা রেখে দিতেই নীল এর নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হলো। ওর মনে হলো নিশাকে ও ঠকাচ্ছে। কিন্তু ওদিকে প্রিয়জিত বাবু বারণ করে দিয়েছেন । সে দিক টা বিবেচনা করে নীল আবার হতাশ হয়ে বসল। নিশা দের বাড়ি একটু বড় রাস্তা থেকে নেমে ভিতর দিকে যেতে হয়। নীল বড় রাস্তা পার হতেই প্রিয়জিত বাবু কে একবার কল করল।

- বাবা আমি প্রায় এসেই গেছি। বড়ো রাস্তা থেকে নেমে এই ঘোষ পাড়া ঢুকছি। 

- আচ্ছা, নীল এসো। আমি তোমার জন্যই বাড়িতে ওয়েট করছি।

ফোন টা রেখে দিয়ে নীল খুব আশ্চর্য হলো। অন্য সময় তাদের আসার কথা থাকলে  ঘোষ পাড়ার মোড়েই প্রিয়জিত বাবু গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আজ তিনি বাড়ি থেকেই বের হন নি। ব্যাপার টা কি? ওনার কি তবে শরীর- টোরির খারাপ হলো নাকি... নিজের মধ্যেয়েই বাক্য গুলো আওড়িয়ে নীল চেঁচিয়ে বললো, দাদা ওই সামনের তিন তলা  বাড়ি টার সামনে দাঁড়াও। নীল গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। নিশা দের বাড়িটা বেশ বড়। দূর থেকেই বাড়িটা দেখে কোনো বড় মন্দির বলে মনে হতে পারে। ধবধবে সাদা রং করা। বাড়িটাকে দেখেই মনে হয় বাড়ির মালিক বেশ শৌখিন। প্রিয়জিত বাবু এত বড় বাড়ি টাকে প্রতি বছরই রং করান। তাই বাড়ি টা চট করেই যে কোনো মানুষেরই দেখলে চোখে লেগে যায়। বাড়ির সামনে বিশাল বড় বাগান। মাঝখান দিয়ে ঢালাই করা রাস্তা। ঢোকার মুখে বিশাল বড় গেট। গেটের পাশে দুদিকের থাম্বয় সিমেন্টের রং করা দুটো বাঘের  মূর্তি। গেট এর বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রিয়জিত বাবুর সাদের চার চাকা গাড়িটি। 

প্রিয়জিত বাবুর  পুরোনো রেস্টুরেন্ট টা শহুরে এলাকা হওয়ায় খুবই জনপ্রিয়। অনেক দূর দূরান্ত থেকে লোকজন ডিনার/ লাঞ্চ করতে আসেন। কাপল রাও আসে সন্ধের দিকে আড্ডা দিতে। প্রথম দিকে ওনার একটি মাত্র রেস্টুরেন্টই ছিল। ক্রমে প্রিয়জিত বাবু তার ব্যবসার বিস্তার করেন। কলকাতায় সাউথ এর দিকে ওনার বেশ কয়েকটি হোটেল ও আছে। ওখানে ভাড়া দেওয়া হয়। অর্থাৎ এক কথায়  বলা যেতে পারে প্রিয়জিত বাবুর সম্পত্তি অনেক। 

নীল যখন নিশা দের বাড়ি প্রথম আসে বাড়ি দেখেই চমকে গিয়েছিল। নিশার সাথে নীল এর বন্ধুত্ব কলেজ লাইফ থেকেই। কিন্তু কলেজে পড়াকালীন কেউ কারোর প্রতিই আকৃষ্ট ছিল না। আর পাঁচটা বন্ধুর মতো নীল ও শুধু ই ফ্রেন্ড ছিল নিশার।  কলেজ পাশ করার পরও সব বন্ধুদের সাথে কানেকশন থাকে। তেমনি নীল এর সাথে ও নিশার ছিল। একদিন নীল , নিশা কে ফোন করে বলে - জানিস চাকরিটা পেয়ে গেছি। কোম্পানির বাইরে সাইট থাকলেও, ঈশ্বরের কৃপায় কলকাতা তেই জয়েনিং দিয়েছে। এরপর কথা বলতে বলতে একে অপরের প্রতি দুজনেই দুর্বলতা অনুভব করে। বেশিদিন অবশ্য ওরা প্রেম করে নি। খুব তাড়াতাড়ি ই নীল ওর মা কে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছিল নিশার বাড়ি। নিশা আগে থেকেই বাবা কে বলে রেখেছিল।

 নিশা দের বাড়ির সামনেই গাড়ি দাঁড়াতেই রিতা দেবী অবাক হয়ে বলেছিলেন, হ্যা রে ... নীল তুই ঠিক জানিস এই বাড়ি টাই তো? 

 - মা আগে তো কোনোদিন আসি নি। তবে নিশা এই বাড়িটার এড্রেস ই দিয়েছে আমায়। বাড়ির গেটের সামনে আবার সিকিউরিটি ও আছে। রিতা দেবী বললেন, নীল এত বড়  বাড়ির মেয়ের সাথে তোর বিয়ের সম্পর্ক না হলেই ভালো। আমরা তো সাদামাঠা লোক। নীল মা কে আস্বস্ত করে বলেছিল, মা তুমি চিন্তা করো না। নিশা খুব ভালো মেয়ে। ওর মধ্যে মানিয়ে চলার ক্ষমতা আছে। আমি ওকে চিনি। ভালোবেসে যত না চিনি বন্ধু হিসাবে আরো ভালো ভাবে। 

ক্লাসের মধ্যে ট্রপার বয় নীল কে প্রিয়জিত বাবুর অপছন্দ হয় নি। নাই হোক বিশাল বড় রিচ ম্যান, নিজের যোগ্যতায় যে ছেলে নামি কোম্পানিতে চাকরি পেতে পারে, সে ছেলে অবশ্যই পরিশ্রমী বটে। প্রিয়জিত বাবু ও তো আর নীলের মতো বয়সে এত কিছুর মালিক হয়ে যায় নি। পরিশ্রম করতে করতে হয়েছে। 

বিয়ের পর থেকে যত বার ই নীল শশুর বাড়ি গেছে, গাড়ি ভাড়া করেই গেছে। প্রিয়জিত বাবু গাড়ি পাঠান নি। তাতে প্রিয়জিত বাবুর  মনে হয়েছিল এতে নীল এর অপমান হতে পারে। তবে বাড়ি থেকে একটু এগিয়ে ঘোষ পাড়ার মোড়ে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন তাদের বাড়ি নিয়ে আসার জন্য। তখন নীল আর নিশা ভাড়া গাড়ি থেকে নেমে বাবার গাড়িতে আসতো। প্রিয়জিত বাবু অত্যন্ত যত্ন করেই নীল, নিশা কে বাড়ি অনত।


সিকিউরিটি গার্ড টার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ হবে । নীল কে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বললো, ভালো আছ জামাই বাবা? 

নীল একটু অন্যমনস্ক ছিল, চমকে গিয়ে একটু থতমত খেয়ে বললো, হ্যা ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো? 

- হ্যা , ভিতরে চলুন। বাবু আজ বাড়ি তেই আছেন ।

নীল বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দেখলো প্রিয়জিত বাবু নিচের তলাতেই ডাইনিং এ সোফার ওপর হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে চোখ বুজে অর্ধ শায়িত অবস্থায় বসে আছেন। এসি র কুলিং পাওয়ার টা হাই মোডে আছে। বাইরের গরম  থেকে হটাৎ করে  ভিতরে আসতেই নীল এর সারা শরীর টা স্যাৎ স্যাৎ করে উঠলো। প্রিয়জিত বাবুর মুখ টার দিকে তাকিয়ে দেখল নীল মানুষটার মুখের মধ্যে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। চোখের নিচে কালি পরে গেছে। একটু ফোলা ভাবও বোঝা যাচ্ছে। চুল গুলো এলোমেলো। খোচা খোচা কাঁচা- পাকা দাঁড়িতে গাল ভর্তি। যেন রাতে হয়তো তিনি ঘুমন নি। এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন।

তবে হাতের তালুর মধ্যে মোবাইল ফোন টা আকড়েই ঘুমোছেন। 


নীল কিভাবে তার উপস্থিতি জানান দেবে ভেবে পেল না। এইদিকে ঘুমন্ত মানুষটাকে জাগাতেও তার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। নীল খুব সন্তর্পনে প্রিয়জিত বাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বললো বাবা...

- কে ... কে 

- আমি নীল বাবা। পা ছুয়ে প্রনাম করে বললো কেমন আছেন? 

- কতক্ষন হলো এসেছ? তন্দ্রা এসে গিয়েছিল একটু। দু হাত এর তালু দিয়ে চোখ রোগড়িয়ে সামনে র টেবিলে থাকা চশমাটা পরে বললেন , ভালো আছো তো?

নীল দেখলো প্রিয়জিত বাবুর হাত- পা তখনও কাঁপছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত নীলের গলার আওয়াজেই তিনি চমকে গেছেন। 


নীল বসতেই আশা মাসি এসে শরবত দিয়ে গেল ওদের দুজনকে। আশা মাসি প্রিয়জিত বাবুর বাড়ি কাজ করেন।  বয়স হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ। প্রিয়জিত বাবু তাকে বললেন, আজএখন  কিছু করতে হবে না। যা আছে আমি আর নীল খেয়ে নেব। তুমি বিকালে আসবে। 

নীল এক নিঃশ্বাসে শরবত টা শেষ করতেই প্রিয়জিত বাবু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ভীষণ জরুরী দরকার নীল তোমার সাথে। নীল চোখের দুপাশ টা কুচকিয়ে প্রিয়জিত বাবুর দিকে ঝুঁকে এলো। প্রিয়জিত বাবু মোবাইল ফোন টা আবার হাতে নিতেই কি মনে হলো দরজার দিকটায় গেল...

- কি হলো আশা দি.. তুমি এখনও যাও নি? 

- না দাদা বাবু... মানে জুতো টা পরতে পারছি না। রোদে তেতে গেছে একদম।

- তোমায় তো কতবার বলেছি জুতো এসে ভিতরে সু ক্যাবিনেট এ রাখবে। কথা তো শোনো না। 

- হে.. হে.. হে... আমরা হলাম গিয়ে কাজের মানুষ। ওখানে জুতো রাখা সাজে? 

- হ্যা ওখানেই রাখবে। এখন বালতি করে জল নিয়ে এসে জুতোয় ঢেলে আগে ঠান্ডা করো তারপর পরো।

প্রিয়জিত বাবু ফিরে এসে বসলেন, সোফায় বসেই দেখতে পেলেন আশা মাসি বেরিয়ে যাচ্ছে।

কৌতুহলী হয়ে নীল জিজ্ঞাসা করলো, হ্যা বাবা বলুন কি বলবেন বলছিলেন? 

- গতকাল ফোন করে একজন ব্ল্যাকমেল করেছে নীল।

ভয় মিশ্রিত গলায় প্রিয়জিত বাবু বললেন। 

- ব্ল্যাক মেল? আপনাকে? কি বলেছে ফোন করে? 

- পাঁচ কোটি টাকা চেয়েছে। নাহলে আমায়...  আমায়

- আপনাকে কি বাবা? 

- নইলে আমাকে আর ঊষা কে মেরে ফেলবে বলেছে। প্রিয়জিত বাবু নীলের হাত দুটো ধরে বললেন,

ভাগ্গিস ঊষা তোমাদের বাড়ি আছে এখন ।  এখন কি উপায় নীল? 

- কে ফোন করেছে? কোথা থেকে করেছে একটু বলুন প্লিজ। 

- সে সব তো কিছু বলে নি। ভয়ে আমি বাড়ি থেকেই বের হই নি।

চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ