অকৃতজ্ঞ অন্তিম পর্ব

 ungrateful last part

আগের পর্ব পড়ুন 

অকৃতজ্ঞ অন্তিম পর্ব


নীল উত্তেজনায় সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ডাইনিং এ পায়চারী করতে থাকলো। প্রিয়জিত বাবু সোফা তেই বিবর্ণ মুখে বসে রইলেন। হঠাৎই নীল প্রিয়জিত বাবুর মুখের কাছে ঝুকে এসে জিজ্ঞাসা করল- আচ্ছা, বাবা কটার সময় ফোন টা এসেছিল? প্রিয়জিত বাবু মোবাইল ফোন টার পাসওয়ার্ড খুলে নীল কে দেখালো । কল টাইম রাত একটা দশ।

- তখন তো আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বাবা , কি তাই তো? 

- আমি বরাবরই একটু রাত করেই শুই। গতকাল  ও শুতে প্রায় পৌনে একটা বেজে গিয়েছিল ।

নীল আবার সোফায় এসে বসলো। হাত দুটো মুঠো করে মাথা নিচু করে, কপালে হাত দুটো চেপে ধরে দু চোখ বুজে কিছু ভাবছিল। তারপর হঠাৎই চোখ খুলে বললো, বাবা আপনি একদম টেনশন করবেন না। আমি আছি তো। আমাদের এখন উচিত থানায় গিয়ে সব টা বলা। 

- না, নীল... আমি থানায় কিছু  জানাতে চাই না। ফোনে এটাও  বলেছে থানায় যাতে না যাই। দরকার নেই নীল। আমি ভাবছি আর এক বার যখন ফোন করবে তখন টাকাটা দিতে রাজি হয়ে যাবো। নাহলে আমার ঊষা মা কে ওরা..

-নেগেটিভ চিন্তা-ভাবনা এইসময় মাথা থেকে সরিয়ে ফেলুন বাবা। জানি আমি বুঝতে পারছি আপনার মানসিক অবস্থাটা। কিন্তু এই সময় মাথা ঠান্ডা রেখেই আমাদের এগোনো উচিত। 

কিন্তু বাবা,  নিশা একটু আগে আমায় ফোন করে বললো, ঊষা  এখন শপিং করতে গেছে।

- কি বলছো কি নীল? আমি এখুনি ওকে ফোন করছি। 

মোবাইল টা হাতে নিয়ে প্রিয়জিত বাবু ঊষা কে ফোন করতে উদ্ধত হলে নীল  বাধা দিয়ে বলে, বাবা আপনাকে কল করতে হবে না। এখন কি বলতে কি বলে ফেলবেন। তার চেয়ে বরঞ্চ আমি কল করছি।


বার পাঁচেক ফোন করা হলেও ঊষা ফোন না রিসিভ করায় নীল ও প্রিয়জিত বাবু দুজনেই খুব টেনশন করতে থাকে। তবু নীল , প্রিয়জিত বাবু কে অভয় দিয়ে বলে, কিছু হবে না। এত তাড়াতাড়ি মনে হয় না  কিছু করতে পারবে। কথা বলতে বলতেই নীল এর মনে পড়ে গেল ওর বন্ধু কুনাল এর কথা। কুনাল হাবিবপুর থানার ওসি। 

নীল আর সময় নষ্ট না করে কুনাল কে ফোন করলো। নীল , প্রিয়জিত বাবু কে অনুরোধ করলেন, যাতে তিনি নির্ভয়ে, বিশ্বাস করে ফোন কল টার ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব টা খুলে বলে। সব টা শুনে, কুনাল বাবু  বললেন, অযথা একটা ব্ল্যাকমেল নিয়ে এত টা ভয় পাবেন না। কেউ হয়তো স্রেফ ভয় দেখানোর জন্য আপনাকে এইরকম করছে। আপনার ব্যবসায়িক কাজে কি কারোর সাথে কোনো ঝেমেলা হয়েছিল ইদানিং? 

প্রিয়জিত বাবু মাথা চুলকে, ঠোঁট কামড়িয়ে বললো, না তো...

আচ্ছা ঠিক আছে। একদম টেনশন করবেন না। নীল এর সাথে আপনি ও চলে আসুন থানায়। 

ফোন টা রেখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঊষা ফোন করল নীল এর ফোনে। রিসিভ করতেই, 

- হ্যালো, জিজু তুমি ফোন করছিলে যখন আমি গাড়িতে ছিলাম। ফোন সাইলেন্ট ছিল। বুঝতে পারি নি। কি বলছিলে বলো...


- আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি এখন কোথায়? 

এই তোমাদের বাড়ি ঢুকছি। নীল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, তুমি একা একা কেন শপিং করতে বেরিয়েছিলে? 

ঊষা,  ইয়ার্কি করে বললো, তোমার তো আর নিয়ে যাওয়ার সময় নেই।  বাড়ি থাকলে শুধু দিদি কে নিয়ে ব্যস্ত। আর অফিস। আমার একা একা সময় কাটছিল না তাই আর কি...

নীল রেগে মেগেই বললো, আর একটাও কথা নয় ঊষা। আমার পারমিশন ছাড়া তুমি আর বাড়ির বাইরে বেরোবে না। 

নীলের ফোনের কথোপকথন শুনেই প্রিয়জিত বাবু বুঝতে পারলেন, ঊষা বাড়ি পৌঁছে গেছে। তাই তিনিও একটু টেনশন ফ্রি হলেন। 


ফোন টা রেখে দিয়েই নীল বললো, চলুন বাবা আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমরা বেরিয়ে পরি থানার উদ্যেশে।


প্রিয়জিত বাবুও নীল এর কথায় সায় দিয়ে দশ মিনিটের মধ্যেয়েই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন। 



শপিং মল থেকে ফিরে এসেই ঊষা শপিং করা জামা , জুতো, জুয়েলারির প্যাকেট গুলো নিচে ডাইনিং টেবিলের ওপর রেখে হন্তদন্ত হয়ে উপরে উঠতে থাকলো।

ঊষা কে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই নিশা উৎসাহ নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলো, কিন্তু ঊষা ওপরে উঠতে উঠতেই বললো, দিদি যা যা কিনেছি টেবিলেই রাখা আছে। আমায় এখন ডিস্টার্ব করিস না। খুব টায়ার্ড আমি। প্লিজ আমায় একটু একা থাকতে দে।

নিশার মনটা মুহূর্তের মধ্যেয়েই খারাপ হয়ে গেল। ও আবার নিজের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলো। ঊষার কিনে আনা জিনিসপত্র গুলো ওর অগোচরে খুলতে ওর বিবেকে বাধল।


রুমে ঢুকেই ঊষা তাড়াতাড়ি করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ফোন টা বেজে উঠলো। ঊষা চমকে গিয়ে রুমের জানালার কাছে উকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলো কেউ আছে কি না। তারপর ফোন টা রিসিভ করে নিচু গলায় বলল, - কি বলছো? 

এখন কেন ফোন করেছ? 

অপর প্রান্ত থেকে পুরুষালি কন্ঠটা বললো, এতক্ষণ ফোনে কার সাথে কথা বলছিলে? ফোন টা ব্যস্ত পেলাম..

 ঊষা বিরক্তির সুরেই বললো, - আরে জিজু ফোন করেছিল।

 - তুমি কি এখনো আমার ওপর চোটে আছো ঊষা? 

 - বাজে কথা ছাড়ো প্রীতম। যা ভুল করার তা তো করেই ফেলেছো। এবার ভালোয় ভালোয় টাকা টা পেলে হয়। 

 প্রীতম ও ঊষার ওপর দ্বিগুন রেগে বললো, তোমার ও দৌড় কতদূর তা এক দিনেই বুঝে গেছি ঊষা।

 - তুমি একটুও ধৈয্য ধরতে পারো না। তাই আজ তোমার এই হাল। কি প্ল্যান ছিল... আর তুমি কি করে বসলে বলো তো? 

 আচ্ছা ব্যাপার টা ঘটানোর আগে একবার ও তুমি আমার পারমিশন নিয়েছ? 

 - তুমি বুঝতে পারছো না ঊষা মিস্টার ভার্মা আমায় আর সময় দিতে চাইছিলেন না, তাই তোমায় না জানিয়েই আমি এই প্ল্যান টা করেছিলাম। 

 - খুব ভুল করেছিলে।

 - কিন্তু তুমি যেটা ভেবেছিলে সেটাই কি ঠিক ছিল তুমি ই বলো। তুমি প্ল্যান করলে তোমার জিজু কে তোমার ভালোবাসার ফাঁদে জড়িয়ে তোমার দিদির সাথে তোমার জিজুর সম্পর্কের ফাটল ধরাবে। আর তোমার দিদি যেহেতু নরম স্বভাবের তোমার সাথে তোমার জিজুকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করবে। তাতে তোমার বাবার পুরো সম্পত্তি র মালিক তুমি হবে। 

 - হ্যা, প্ল্যান তো ওটাই ছিল প্রীতম। তবে এখন কেন অবার এইসব নিয়ে কথা বলছো। আমি তো কথা মতো দিদির বাড়িতেই এখন ছিলাম।আমায় না জানিয়ে চাল পাল্টেছো তুমি। এবার তুমি একাই যা পারো সিদ্ধান্ত নেবে। 

 ঊষা প্লিজ শান্ত হও। রাগ করো না। মাথা ঠান্ডা করো। তুমি দেখা করতে এসেও ভালো করে কথা পর্যন্ত বললে না। নিজের ইচ্ছা মত শপিং করে তাড়াহুড়ো করে চলে গেলে...

 - তা না হলে কি করতাম? তোমার মত ভীতু একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রেম করতাম?

 - ঊষা একবার ভেবে দেখো , নিশা তোমার নিজের দিদি। আপন মায়ের দুই সন্তান তোমরা। তুমি এই ভাবে নিশাকে আত্মহত্যা য় প্ররোচনা দেবে , সেটা আমি মনে থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। ইনফ্যাক্ট আমাদের তো তোমার বাবার পুরো প্রপার্টি টা নেওয়ার কোনো দরকার নেই। পাঁচ কোটি পেলেই আমি মিস্টার ভার্মার থেকে হোটেল টা পেয়ে যেতাম। আরামসে ব্যবসাটা শুরু করতে পারতাম। তাছাড়া তুমি তো নিজেই বলেছো গতকাল, তোমার জিজুকে ফাঁদে ফেলা মুশকিল। সে তোমার দিদি কে ছাড়া কিছু বোঝে না। তাছাড়া আমি খুনো খুনিতে নেই। তাই এই প্ল্যান টা করেছিলাম। তোমায় না জানিয়েই। 

 - আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। আমি ফোন রাখছি প্রীতম।

 - হ্যালো, ঊষা প্লিজ ফোন টা কেট না। তোমার কি মনে হয় তোমার বাবা ভালোয় ভালোয় টাকাটা দিয়ে দেবে নাকি পুলিশ কেস করবে? 

 -জানি না। আমি ফোন রাখছি।

 ফোন টা কেটে দিয়ে ঊষা বিছানার উপর ধপাস করে বসে পড়লো। 

 দরজায় নক করার আওয়াজে ঊষা একটু চমকে গেল।

 - কিরে ঊষা দরজা খোল। তোর জন্য শরবত করে এনেছি। 

 ঊষা আয়নার সামনে নিজেকে একবার দেখে চুল গুলো হাতে করে পিছনে টেনে ক্লিপ দিয়ে দরজা খুলল।

 -খুব টায়ার্ড হয়ে গেছিস তাই না রে? এই নে তোর জন্য শরবত করে আনলাম। 

 -তুই আবার কষ্ট করে সিঁড়ি ভেঙে শরবত আনতে গেলি কেন? আমি নিজেই যেতাম একটু পরে নীচে। 

 -বাবা! তুই দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছিস। কে বলে তোকে বাচ্ছা মেয়ে। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেলি। তোর হয়তো মনে নেই ঊষা মা মারা যাওয়ার পর আমি তোকে খাইয়ে দিতাম। আশা মাসি বলতো তুমি পারবে না নিশা দিদিমণি , তুমি তো নিজেই এখন ছোট। দাও, আমি ই খাইয়ে দিচ্ছি। কিন্তু অবাক কান্ড তুই ওর হাতে খেতে চাইতিস না। কান্নাকাটি করতিস, আমার অনভ্যস্ত হাতেই তুই চুপটি করে খেয়ে নিতিস। আমি ঘুম পাড়ানি গান জানতাম না। কিন্তু তুই কিছুতেই অন্য কারো কাছে ঘুমোতে চাইতিস না। আমি যে কয়টা ছড়া জানতাম সুর করে করে গাইতাম তুই আমার বুকের কাছে সেটে শুয়ে শুয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পারতিস। জানিস ঊষা, বাবা একবার তোকে লুকিয়ে রেখেছিল, আমায় জব্দ করার জন্য ব্যাপার টা আশা মাসি কে বলে রেখেছিল। বাবা আমায় এসে ব্যস্ত হয়ে ভয়ে ভয়ে বললো, ঊষা কে দেখেছিস নিশা। ওকে খুঁজে পাচ্ছি না। 

 আমি তো কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, তোমার সাথেই তো ও ছিল, বাজারে নিয়ে গেলে। 

 বাবা বললো, হ্যা তো। কিন্তু বাজারের মধ্যে ভিড়ে কখন যে আমার হাত টা ছেড়ে দিয়েছে খেয়াল করি নি রে। বাড়ি তে আসে নি ঊষা? 

 আমি তো ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম, কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ও তো ছোট। ও কিরে একা একা বাড়ি আসবে? ওইটুকু বলেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কোনো হুশ ছিল না।

 বাবা ভাবতে পারে নি ইয়ার্কির ফল এইরকম হবে। তারপর থেকে বাবা তোকে নিয়ে এই রকম ইয়ার্কি আর কোনো দিন করেন নি। তারপর তো একটু বড় হতেই তোকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। 

 এইসব কথা শুনতে শুনতে ঊষার চোখের কোন ভিজে গেল। ওর নিজের অজান্তেই দু গাল বেয়ে নোনা জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল। 

নিশার কাঁধে হাত দুটো রেখে , নিশার চোখে চোখ রেখে বললো, খুব ভালোবাসিস না রে দিদি আমায়? 

নিশারও চোখ দিয়ে জল পড়ছিল  ছোট বেলা কার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে। 

ঊষাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, খুব ভালোবাসি রে। খুব। তুই তো আমার  মা। তোর মধ্যে তোর চোখে- ঠোঁটে- গালে আমার মা কে অনুভব করতে পারি। তুই আমার মা। এই বলে নিশা ঊষা কে জড়িয়ে ধরলো। 

- আমি যদি কিছু ভুল করে থাকি আমায় ক্ষমা করে দিতে পারবি তো দিদি? 

- তুই তো চিরকালই আমার কাছে সেই ছোট্ট ঊষা। তোর সব ভুলই আমি ক্ষমা করে দেব। 

নিশার অজান্তেই ঊষা বিবেকের দংশনে পুড়তে থাকলো। 


নিশা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই, ঊষা মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে কাঁদতে থাকলো।  ভাবতে থাকলো গতকাল ওর জন্মদিন ছিল কি সুন্দর করেই  দিদি ডেকোরেটর দিয়ে ঘর সাজিয়ে ছিল। কষ্ট করে নিজের হাতে সব  খাবার রান্না করেছিল। আর ও ইচ্ছা করেই ওর দিদি কে হার্ট করার জন্য মুখ কুচকিয়ে বারবার বলছিল এইসব খাবার নাকি ওর পছন্দ নয়। 

- আমি তোকে এত কষ্ট দিয়েছি দিদি। সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়ও ইচ্ছা করেই তোকে যেতে বলি নি। শুধু মাত্র একটা বিশ্রী খেলায় মেতে উঠেছিলাম বলে। ঊষা, নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজের নখ দিয়ে সারা শরীর আছরাতে থাকলো, চুলের মুঠি ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো। আমি অকৃতজ্ঞ দিদি। আমি একজন অকৃতজ্ঞ। আমি তোর ক্ষতি চেয়েছিলাম । হ্যা, আমি তোর ক্ষতি চেয়েছিলাম। আমায় বিশ্বাস করিস না রে দিদি। আমার যে... আমার যে... নিঃশ্বাস এও বিষ আছে। প্রীতম একজন অন্যের ছেলে হয়েও তোর ক্ষতির প্ল্যান টা চায় নি। আর আমি কিনা তোর ক্ষতি চেয়েছিলাম... হে ভগবান, 

 আমার কেন মরণ হলো না। আমি এই কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। শুধু মাত্র নিজের সুখের কথা চিন্তা করে আমি মায়ের মতো দিদির মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেছিলাম । আমার মতো অকৃতজ্ঞ এর কোনো জায়গা নেই এই পৃথিবীতে। 



কতক্ষন পাগল এর মত এই ভাবে মেঝেতে লুটিয়ে ও কাঁদছিলো ঊষা নিজেই বুঝতে পারে নি। ও ওখানেই লুটিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশা আর ঊষাকে ডাকতে গেল না। ঊষার কান্নাভেজা চোখ দুটো দেখে নিশার মনে হয়েছিল ও এখন সত্যিই বড় ক্লান্ত। কোনো সাড়া শব্দ নেই যখন তাহলে ও নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙলে ও নিজেই আসবে। এইদিকে ঊষার ফোনে প্রীতম একটার পর একটা মেসেজ করেই চলেছে ঊষার দিক থেকে কোনো রিপ্লাই না পেয়ে ও খুব টেনশনে আছে। 


প্রীতম সাধারণ ঘরের ছেলে। ঊষার সাথেই এক সাথে পড়তো। মুম্বাই এ বাড়ি। ওর দাদা রও একটা মুম্বাই এ হোটেল আছে। সেটারই  দেখাশোনা করে। প্রীতম এরও খুব ইচ্ছা ছিল মুম্বাই শহরে একটা হোটেল কিনে ব্যবসা শুরু করার। ঊষার সাথে প্রীতমের সম্পর্ক এক বছরের। এরই মধ্যে কলেজ শেষ হওয়ার মুখোমুখি ওরা বিয়ের প্ল্যান ও করে। যদিও বিয়ের প্ল্যান টা ছিল ঊষারই। প্রীতম চেয়েছিল নিজে কিছু একটা করে তারপর ঊষাকে বিয়ে করবে। কিন্তু বেকার যুবক প্রীতম কে এত টাকার লোন কেউই দিত না। তাই ঊষাই ওই প্ল্যান টা করে। প্রীতম সায় দিয়ে হাত মেলালেও খুন খারাপি করার ওর ইচ্ছা ছিল না। সেই কথা মতোই ঊষা দিদির বাড়ি আসে। 

তখনই ঊষা ফোন করে বলে প্রীতমকে  নিশা প্রেগনেন্ট। তাই প্রীতম সব শুনে ঊষা কে এক প্রকার না বলেই নিজেই প্ল্যান চেঞ্জ করে। 


নীল আর প্রিয়জিত বাবু থানায় পৌঁছে গতকাল রাতে যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিল সেই নম্বর টা কুনাল বাবু কে দেন। কুনাল বাবু নম্বর টা ট্রাকে ফেলে দেখতে দেয়। লোকেশনটা কোন জায়গা কার। কিছুক্ষনের মধ্যেই মোবাইল নম্বরটার লোকেশন জানতে ওরা সমর্থ হয়। কুনাল বাবু কৌতুহলী হয়ে প্রিয়জিত বাবুর দিকে এগিয়ে এসে বলেন, লোকেশন তো দেখাচ্ছে মোহনপুর, নেয়ার  সোনালী শপিংমল। ওদিকে কি আপনার কোনো ব্যবসায়িক লোকজন থাকে? 

প্রিয়জিত বাবু ভেবে বললেন না তো! 

কুনাল বাবু বললেন আচ্ছা ঠিক আছে। ব্যাপারটা দ্রুত সলভ করার চেষ্টা করছি। তার আগে ঊষা কে সেভ রাখা খুব জরুরি। এখনই একবার নীল এর বাড়ি গিয়ে ঊষাকে সব টা বলে সাবধান করা দরকার। 

প্রিয়জিত বাবু বললেন, আমি ও যাবো আপনাদের সাথে। 

কুনাল বাবু একটু চিন্তা করে বললেন, অসুবিধা নেই চলুন। ঊষা কে তো আমরা সব টা বলতেই যাচ্ছি। 


ঊষা ঘুম থেকে উঠে দেখে প্রীতমের দশ টা মেসেজ। মেসেজ গুলো পড়ে নিশা সঙ্গে সঙ্গে প্রীতম কে কল ব্যাক করে। 

- এতক্ষন কি করছিলে? কখন থেকে মেসেজ করে যাচ্ছি।

- ঊষা একটু নাক টেনে বললো , ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুমি ঠিকই ডিসাইড করেছ প্রীতম, আমাদের ভুল গুলো জিজুকে বলে ক্ষমা চাওয়া উচিত। একমাত্র জিজুই পারে, বাবা কে বোঝাতে। আমাদের ক্ষমা করে দিতে। আমার মতো অকৃতজ্ঞ র মুখ নাহলে কেউই দেখবে না। তুমি চলে এসো তাড়াতাড়ি জিজুর বাড়ি। আমি এড্রেস দিচ্ছি। জিজুর অফিস থেকে বাড়ি আসার সময় হয়ে গেছে। প্রীতম ফোন রেখে দিল।


কুনাল বাবু গাড়িতে যেতে যেতে বললেন, যে বা যারা  ব্ল্যাকমেল করেছে, তারা প্রফেশনাল নয়। খুবই কাঁচা। আপনি চিন্তা করবেন না প্রিয়জিত বাবু। খুব শীঘ্রই আমি ধরে ফেলবো। নীল এর বাড়ি ঢুকতেই, নিশা বাবা কে দেখে খুশি হয়। নীল আর প্রিয়জিত বাবুর সাথে কুনাল বাবু কে  দেখে নিশার মনে কোনো সন্দেহ জাগে না। কারণ কুনাল বাবু নরমাল ড্রেস পরেই এসেছিলেন। তাছাড়া উনি হামেশাই সন্ধের দিকে আসে নীলের সাথে গল্প করতে। 


নীল এর সাথে বাবাকে দেখে ঊষা উপর থেকে দৌড়ে আসে। ততক্ষনে কুনাল বাবুর চোখে পড়ে যায় টেবিলে সোনালী শপিং মলের ব্যাগ পরে আছে। কুনাল বাবু হাতের ইশারায় নীল কে দেখায়। নীল অবাক হয়ে একবার ঊষার দিকে, একবার কুনাল বাবুর দিকে তাকান। কুনাল বাবু ইশারায় বোঝাতে চায় হ্যা কান্ড টা ঊষার ই। নীল অবাক হয়ে যায়। 


ঊষা দৌড়ে এসে প্রিয়জিত বাবুর পা ধরে কাঁদতে থাকে। বাবা,  আমি অকৃতজ্ঞ বাবা। আমি ই প্লান করে তোমায় ব্লাকমেল করেছিলাম। আমায় তুমি পারলে ক্ষমা করে দাও বাবা।আমি তোমাদের ভালোবাসার অযোগ্য। তোমার কু- সন্তান। নিশা তো পুরো শকড । নীল ওকে ধরে চেয়ারে বসায়। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে নীল দরজা খুলে দেখে একটা অল্পবয়সী ছেলে অপরাধী মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঊষা দেখে বললো, ওকে আসতে দাও জিজু। প্রীতম ঢুকতেই ঊষা বললো, আমরা দুজন মিলে এই প্ল্যান টা করেছিলাম। ও প্রীতম বাবা।  প্রীতমের ব্যবসার জন্য টাকার দরকার ছিল তাই। ব্যবসা টা দাঁড়িয়ে গেলেই ও আমায় বিয়ে করত।


প্রিয়জিত। বাবু ঊষা কে বুকে টেনে এনে বললেন, নিশা আর ঊষা তোরা দুজনই তো আমার সব রে। তোদের জন্যই তো এত কিছু। তুই কি করে ভাবলি তুই যাকে ভালোবাসিস, সে নিজের পায়ে দাঁড়াক আর আমি তাকে সাহায্য করব না? 

ঊষা আবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো। আর বলতে থাকলো বললাম তো আমি বড় অকৃতজ্ঞ বাবা। পারলে ক্ষমা করো। প্রীতমের দিকে এগিয়ে এসে প্রিয়জিত বাবু তাকে জড়িয়ে ধরতে আসেন। প্রীতম প্রিয়জিত বাবু র পা ধরে ক্ষমা চায়। 

- তোমাদের স্হান আমার পায়ে নয়। আমার বুকে। প্রিয়জিত বাবু প্রীতম ঊষা দুজনকেই জড়িয়ে ধরেন। আবেগে প্রিয়জিত বাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। চোখ মুছে সিরিয়াস হয়ে বলেন প্রিয়জিত বাবু,  প্রীতম কে আমি কিন্তু তোমায় অতগুলো টাকা কখনোই দেব না। কলকাতার সাউথের দিকে আমার চলতি দুটো হোটেল আছে। আমি চাই প্রীতম ও দুটোর দায়িত্ব নিক। নিজে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করুক। কুনাল বাবু শুনে মিটিমিটি হাসলেন। 

নিশা ও খুশি হয়ে বললেন, সকলে বসুন। আমি সকলের জন্য মিষ্টি, চা, জল খাবারের ব্যবস্থা করছি। 

সমাপ্ত


ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ