একটি গ্রাম্য মেয়ের সফলতার কাহিনী
উচ্চ মাধ্যমিক এর রেজাল্ট বের হওয়ার পরই রাই এর মা , বাবা ঠিক করেন, রাই কে কলকাতায় একটি ভালো কলেজে ভর্তি করাবেন। রাই এর জন্ম দক্ষিণ দিনাজ পুরের একটি ছোট্ট গ্রামে। এই গ্রামটির প্রায় বেশির ভাগ মানুষই চাষ বাস করেই জীবিকা অর্জন করেন। রাই দেরও প্রায় পনেরো বিঘা জমি। রাই নিখিল বাবু ও অনিমা দেবীর একমাত্র সন্তান। রাই কে ওর মা, বাবা পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ, গান , আঁকা, আবৃত্তি সব রকমই শিখিয়েছেন। নিখিল বাবুর খুব ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ক্যারাটে ও শেখাবেন। কিন্তু ওখানে মেয়েদের জন্য সেইরকম সুযোগ ছিল না।
গ্রামের অনেক বয়স্ক মানুষরাই নিখিল বাবু কে বলেছেন, " আমাদের রাই মায়ের তো মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেল , এবার ওকে পাত্রস্ত করার ব্যবস্হা করো নিখিল।"
ওকথা শুনে নিখিল বাবু একগাল হেসে বলতেন, ঠাকুরের কৃপায় এই জমি গুলো থেকে খেটে ভালো ফসল ই ফলাই আমি। ভগবান যখন আমায় আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল করেছেন, তখন আমার লক্ষহী মেয়েটাকে আমি অনেক দূর পর্যন্ত পড়াবো। ওর বিয়ে থা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ও আগে লেখা পড়া শিখুক, প্রতিষ্ঠিত হোক, তারপর ওর সিদ্ধান্ত ও নিজেই নিতে পারবে। আমার আশীর্বাদের হাত সবসময় ওর মাথার ওপর আছে। আর রাই এর ওপর আছে আমার অগাধ বিশ্বাস।
রাই পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ছাত্রী । ওর গানের গলা খুব সুন্দর। ভোর বেলায় ওর রেওয়াজ শুনে প্রতিদিন নিখিল বাবুর ঘুম ভাঙত। চা এর কাপে চুমুক দিয়ে নিখিল বাবু , অনিমা দেবীকে বলতেন, আমাদের রাই মা য়ের গানের গলা খুব সুন্দর তাই না গো? অনিমা দেবী আলগা হেসে বলতেন, শুধু কি গানের গলা, নিজের মেয়ে বলে বলছি না , ওর মতো শান্ত, নিরীহ, মেয়ে খুব কমই আছে।
মাধ্যমিকের গন্ডি পার হতে না হতেই রাই এর বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যায়। লোকেরা নিখিল বাবু কে এই নিয়ে নানান কথাও শোনান। দু- একটা কথা রাই এর কানেও যায়। ওর বাবা- মায়ের জন্য কষ্ট ও হয়। কিন্তু ওর ও খুব ইচ্ছা আরো পড়াশোনা করার। মা- বাবা রাই এর পক্ষে থাকলেও সমাজের নানা কুটুক্তি তে রাই দিশাহারা হয়ে পড়ে।
আজ রাই কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য কলকাতায় যাবে। উত্তেজনায়, ভয়ে, একরত্তি মেয়ে টার যেন চোখ- মুখ শুকিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অনিমা দেবীর চোখের জল দেখে রাই আরো ভেঙে পড়েছে। হাজার কষ্ট বুকে চেপে রেখে এক গাল হেসে নিখিল বাবু বলেন, " আরে, কাঁদছো কেন তোমরা, মাত্র তো কয়েকটা বছরের ব্যাপার রাই এর পড়া শেষ হয়ে গেলেই ও আবার ফিরে আসবে। তাছাড়া ও তো মাসে একবার করে এখানে আসবেই। আমরাও যাবো ওর সাথে দেখা করতে। " বেরোনোর সময় চোখের জল ফেলতে নেই অনিমা, হাসি মুখে মেয়েকে যেতে দাও। " রাই মা কে প্রনাম করে মুখ নিচু করে উঠে দাঁড়ালো। ভালো করে পড়াশোনা করিস রাই, তোর বাবা অনেক আশা নিয়ে তোকে বাইরে পাঠাচ্ছেন। "
রাই ঘাড় নাড়িয়ে দরজার সামনে এগিয়ে গেলো। আসি গো অনিমা। মেয়েকে ভর্তি করিয়ে ঘর ভাড়া ঠিক করে পরশু দিন ফিরবো।
সদ্য গ্রাম্য পরিবেশ থেকে এসে কলকাতা শহর টাকে বড়ই অচেনা লাগলো রাই এর। সবাই এর সাথে মিশতেও ওর ভয় লাগতো। অচেনা, অজানা জায়গায় পড়তে এসে ওর মনে নানা কু- চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকতো। কলেজের প্রথম দিন তো সিনিয়ররা রাই কে হালকা রেগিং করার ও চেষ্টা করেছিল। যদিও সেটা তেমন কিছু গুরুতর ছিল না। শহরের মানুষ , ছাত্র- ছাত্রী গুলোকে রাই একটু এড়িয়েই চলতো। ও নিজেই নিজের মতো থাকতে পছন্দ করতো। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই ওর ভুল ভ্রান্তি গুলো কেটে গেল। ও দেখলো চাল - চলন এ একটু আলাদা হলেও ওরা রাই কে খারাপ চোখে দেখে না। তাই অতি সহজেই তাদের সাথে রাই এর বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
রাই এর আর কলকাতায় থাকতে বিশেষ ভয় করে না। শহর টাকে ও ভালোবেসে ফেলেছে। একটু একটু করে প্রতিদিন চিনছে এই তিলোত্তমা কে। এখানে রুষা, অদিতি, প্রিয়ম, রাহুল, নিবেদিতা ছাড়াও ওর একজন স্পেলাশ বন্ধু হয়েছে নাম ওম। ওরা একসঙ্গে কলেজে আড্ডা দেয়, লাইব্রেরী তে গিয়ে গ্রূপ ডিস্কাস করে। ক্যান্টিন এ গিয়ে খাবার কাড়াকাড়ি করে খায়। আবার ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে যায়, কিংবা কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে দল বেঁধে।
নিখিল বাবু ও অনিমা দেবীও খুব খুশি এই ভেবে যে, ওনা দের মেয়ে ওখানে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছে। ফোনে রাই এর গলা শুনে ওরা বুঝতে পারে, মেয়ে ওখানে ভালোই আছে। রাই সব কথাই ওর মা, বাবার সাথে শেয়ার করে। ওম যে তার বিশেষ বন্ধু এ কথাও সে তার মা, বাবা কে জানিয়েছে।
ওম থাকে কলকাতাতেই। গড়িয়ার কাছে। এখানেই ওর জন্ম। ওম এর বাবা ওদের কলেজ এরই প্রফেসর। কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে র দিন রাই এর গলায় রবীন্দ্র সংগীত শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছেন। পাশাপাশি রাই এর নম্র, সভ্য, গুন দেখে তিনিও রাই কে স্নেহ করতেন।
ওম এর মুখে রাই আর ওর সম্পর্কে র কথা শুনে ওমের বাবা কোনো আপত্তি করেন নি। ওমের মা মিনা দেবী বলেন, আমারও যে খুব ইচ্ছে রাই কে দেখার। ওম মা কে জড়িয়ে ধরে বলে ওতো তাড়া কিসের মা , সময় হলে ঠিক ই ওকে নিয়ে আসবো। আগে দুজনে পড়াশোনা কমপ্লিট করি, নিজের পায়ে দাঁড়াই দুজনে, তারপর ওর সাথে তোমায় পরিচয় করিয়ে দেব।
রাই ছুটি পেলেই বাড়ি চলে আসে। অনেকদিন পর পর আসায় ওর মা ওকে পেলেই খুব খুশি হয়। যত্ন করে ওর পছন্দের চিংড়ি মাছের মালাইকারি , ইলিশ ভাপা, ঝিঙে পোস্ত, কড়াই এর ডাল রাধে। রাই ও মা কে কয়েকদিন খুশিতে রাখার জন্য ওই দিন গুলোয় সবসময় মায়ের সাথেই থাকে। মা কে রান্না ঘরে হাতে হাতে সাহায্য করে।
নিখিল বাবু এইদিন গুলোয় খুব ব্যস্ত ও ফুরফুরে মেজাজে থাকে, ভোর হলেই বেরিয়ে পড়েন জমিয়ে বাজার করতে, নাহলে যে বাজারে ভালো মাছ পাওয়া যাবে না। সবজিও টাটকা পাওয়া যাবে না। এখন আর কেউ নিখিল বাবু কে মেয়ের বিয়ে নিয়ে উসকায় না। রাই এখন ওদের গ্রামের গর্ব। ওই প্রথম গ্রামের মেয়ে যে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় পড়ছে। ওকে দেখে গ্রামের আরো কয়েকজন বাবা- মায়ের ভরসা হচ্ছে মনে , তাদের মেয়েকেও ভবিষ্যতে বাইরে পাঠাবে পড়তে।
দেখতে দেখতে পাঁচ টা বছর কেটে গেল। রাই ল পাশ করে এখন একজন বড় উকিলের আন্ডারে প্র্যাকটিস করে। ওম ও একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল। দুজনেই এখন কাজের চাপে ভীষণ ব্যস্ত। আগামী কাল সরস্বতী পুজো। ওম এর মা খুব জেদ ধরেছেন, আগামী কালই রাই কে ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।
- হ্যালো, ওম
- কি হলো রাই, এত রাতে কল করেছিস কিছু প্রবলেম নাকি? চোখ রোগড়িয়ে ওম জিজ্ঞাসা করলো।
- না, রে ঘুম আসছে না।
- কাজের খুব প্রেসার তাই না? রেস্ট নে। রিল্যাক্স এ ঘুমানোর চেষ্টা কর। দেখবি সকালে ফ্রেস লাগবে।
- ধুর! সেইসব কিছু না।
- তবে কি?
- আসলে কাল আন্টির সাথে মানে তোর মায়ের সাথে দেখা করতে যাবো তো তাই একটু নার্ভাস ফিল করছি। ঘুম আসছে না কিছুতেই।
ওম সহাস্যে বললো, কাল তো সরস্বতী পূজো। কাল কিন্তু শাড়ি পরিস কেমন। আমিও তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব।
- উফঃ আমি মরছি টেনশনে, আর উনি সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা চিন্তা করছে।
- শোন, চিন্তা করতে হবে না। মা খুবই মিশুকে। আমার সাথে বন্ধুর মতোই মেশে। কাল আসলেই বুঝতে পারবি।
পরদিন সকাল বেলায় রাই একটা লাল পাড়, সাদা শাড়ি পরলো। চুলটা আলগা খোঁপা করে সাদা জুঁই এর মালা পরলো। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, ছোট্ট টিপ পরলো।
দূর থেকে রাস্তায় অপেক্ষারত রাই কে দেখে ওম নিজেই ক্যাবলা হয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলো। আচমকা ওম কে এইরূপে , এই পোশাকে দেখে রাই ও কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর রাই ই বললো, কি হলো ওম ধুতি, পাঞ্জাবি পরে ক্যাবলা হয়ে গেলি নাকি?
ওম আশ্চর্য হয়ে বলল, ভাবলাম আজ কের দিনে ধুতি , পাঞ্জাবি পরে তোকে সারপ্রাইজ দেব। এইদিকে দেখছি তুই ই আমায় চমকে দিলি। বাই দ্যা ওয়ে, তোকে কিন্তু অপূর্ব লাগছে রাই। এইরকম রূপে তোকে আগে কখনো দেখি নি। আবার তোর প্রেমে পড়ে গেলাম। রাই লজ্জা মাখা গলায় বলল তোকেও খুব সুন্দর লাগছে। একদম খাঁটি বাঙালী।
দুজনে হাত ধরে হাটতে হাটতে কলকাতা শহর টা কে নতুন করে উপলদ্ধি করতে থাকলো। গুন গুন করে একে অপরের দিকে চেয়ে গেয়ে উঠলো। কখনো " তুমিও হেটে দেখো কলকাতা" কখনো "এক কাপ চা এ শুধু তোমাকে চাই" । গানে গানে ওরা অনেকটা পথ হেটে কলকাতা শহর কে ছুঁয়ে দেখলো। হাটতে হাটতে ওম বললো, এখানেই থামতে হবে ম্যাডাম।
ভ্রু কুঁচকে রাই বললো কেন?
- এই বাড়ি টাই যে আমাদের। মা তোর জন্য ওয়েট করছে।
দরজা খুলতেই মিনা দেবী দেখলেন যেন সত্যি কারের মা সরস্বতী শুভ্র তায় পরিপূর্ণ হয়ে সমুখে দাঁড়িয়ে। মিনা দেবী খুব খুশি হয়ে রাই কে ঘরে নিয়ে বলেন। ওম এর বাবা বললেন, কি গিন্নি বলেছিলাম না, সাক্ষাৎ মা সরস্বতী, যেমনি রূপ, তেমনি গুন। ও সাক্ষাৎ সরস্বতী র আশীর্বাদ ধন্যা। ওর গানের গলা শুনলেই বুঝতে পারবে। রাই এর মুখ টা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মিনা দেবী গেলেন ঠাকুর ঘরে বরণ ডালা আনতে মানুষ রুপী মা সরস্বতী কে বরণ করার জন্যে।
সমাপ্ত
1 মন্তব্যসমূহ
Sondor
উত্তরমুছুন