নীরবে ভালোবাসি - পর্ব-১
সময়টা একেবারে এপ্রিলের শুরু। এই সময়টা সূর্য্যের উত্তাপের তিক্ষতাও প্রবল থাকে না। বেশ কয়েকবছর আগেও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বার্ষিক পরীক্ষা র ফলাফল এই সময়টা বের হতো। ফেব্রুয়ারি র শেষ এর দিকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হতো। আর শেষ হতে প্রায় মার্চের মাঝামাঝি হয়ে যেত। এই পরীক্ষা চলাকালীন ই প্রতি বছর হোলি উৎসব টা থাকতো। ফলে পড়াশোনার চাপে সেইরকম উৎসাহ এর সহিত আর সেই উৎসবে মাতামাতি থেকে অনেক পড়ুয়ারাই বিরত থাকতো। অভিবাবক রাও বেশ সতর্ক থাকতেন। পাছে রং খেলে সন্তানের ঠান্ডা লেগে যায় তাহলে তো পরীক্ষা টাই হয়তো দিতে পারবে না। শ্রীলতার মাও তাকে হোলি উৎসবে রং খেলতে বারণ করে দিয়েছিল এই বছর। বলেছিলেন - মাঝে এই একটা দিন ছুটি আছে। পরের দিন ই অঙ্ক পরীক্ষা। সারাদিন বসে অঙ্ক প্রাকটিস কর। শ্রীলতার এই এক সমস্যা । ইতিহাস, ভূগোল, বাংলা এইসব বিষয়ে সে আশানুরূপ নম্বর পেলেও অঙ্ক, ভৌত বিজ্ঞানে সে বরাবরই কাঁচা। সারাবছর প্রাকটিস করেও সে এই বিষয়টা কে রপ্ত করতে পারে না। আর ও কিনা পরীক্ষার আগের দিন প্রাকটিস করে সব মগজাস্ত করে ফেলবে... এও কি সম্ভব? শ্রীলতা জানে তার মা কে এব্যাপারে বোঝানো বৃথাই চেষ্টা। অগত্যা অংকের খাতা নিয়ে বসে পেন টা মুখে ঠেকিয়ে সে মাঝে মাঝেই জানালা পানে চেয়ে বাইরে ছোট ছোট ছেলে- মেয়েদের রং খেলা দেখেছে। আর মনে মনে ভেবেছে ইস! আমিও যদি এইসময় টা ছোট থাকতাম খেলতে পারতাম। তবুও এবছরও শ্রীলতার অঙ্ক পরীক্ষা ভাল হয় নি। আর হবেই বা কি করে... ও তো প্রথম থেকেই সাবজেক্ট টাকে রীতিমতো ভয় পেয়ে এসেছে। এই বছরও তাই বুক ঢিপঢিপ করছে ওর। আদেও পাশ করতে পারবো তো? আর তো মাত্র হাতে গোনা দুটো দিন। তারপরই বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল। এর মাঝে বেশ দুই সপ্তাহ ভালোই আনন্দ করে কেটেছে। না ছিল পড়াশোনার চাপ, না ছিল স্কুল যাওয়া, পড়তে যাওয়ার তাড়া। বেশ ভালোই পাড়া তুতো বন্ধুদের সাথে হেসে আড্ডায় সময় অতিবাহিত হয়েছে। সকালের দিকে রেজাল্ট আউটের কথা মনে পড়তেই শ্রীলতা ঝেরেমেরে বিছানায় উঠে বসে। জোর হাত করে মাথা নিচু করে বলে হে, প্রভু...তুমি দয়াময়; তুমি অন্তর্যামী। তুমি তো সবটাই দেখছো, জানছ। দয়া করো প্রভু। অন্তত এবছর টা আমায় অংকে পাশ করিয়ে দাও। তোমায় কথা দিলাম পরের বছর থেকে খুব মন দিয়ে , যত্ন সহকারে অঙ্ক এর দিকে বিশেষ নজর দিয়ে প্রাকটিস করবো নিয়মিত। তুমি তো জানোই বাবা আমায় কত কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। আর আমি যদি ফেল করি সারাবছরের বই-খাতা-পেন- টিউশন খরচ সব পন্ড হয়ে যাবে। তাহলে বাবা- মা কে মুখ দেখাবো কি করে। তাছাড়া এই বছর আমি নবম শ্রেণীতে উঠবো। তাই আরও বেশি করে আমায় পড়তে হবে সেইসব চিন্তা ভাবনাও করে রেখেছি। তুমি প্লিজ আমায় এবছর টা পাশ করিয়ে দাও। চোখ বুজে কথা গুলো বলতে বলতে শ্রীলতার চোখ দিয়ে দুফোটা নোনা জলের ধারা গাল বেয়ে সরলরেখা বরাবর নেমে এলো।
- হ্যা রে, পড়াশোনা নেই বলে কি এত বেলা অবধি বিছানা কামড়ে পরে থাকবি? তোর অভ্যাস টা কিন্তু এই ছুটির কদিনে খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এরপর স্কুল চালু হয়ে গেলে সকাল বেলা পড়তে যেতে কষ্ট হবে।
-ধুর ! মা...।সাতসকালে বোকো না তো।
-হ্যা, রে তোর চোখে জল কেন রে? সাত সকালে কাঁদতে বসেছিস কেন?
মায়ের কথা শুনে শ্রীলতা চট পট হাতের তালু দিয়ে জলের রেখা দুটো মুছে নিলো।
-ও কিছু নয়...তুমি চা গরম করো । আমি যাচ্ছি।
-আহা! নবাব নন্দিনী বেলা করে ঘুম থেকে উঠবেন। আর আমায় চা রেডি করে রাখতে হবে। বলি, সারাবছর তো কোনো কাজেই হাত লাগাতে দি না তোকে। এই ছুটির কোয়েকদিনেও কি সংসারের কোনো কাজ করা যায় না?
মায়ের গলার তীক্ষ্ণ আওয়াজ শুনেই শ্রীলতা বুঝতে পেরে যায় তার মা আজ কে সকাল সক্কাল ভালোই চটে আছে।সুতরাং কথা না বাড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে বদ্ধ ঘরের জানালা গুলো খোলার জন্য আগে মশা রিটা খুলে বিছানার এক কোনে রাখে। এরপর জানালার ছিটকিনিটা খোলা মাত্রই সে দেখল পুবের ঝলমলে হলুদে মিঠে রোদ হুড়মুড় করে তার ঘর খানি দখল করে বসল। সাথে একটা মিষ্টি বাতাসের আনাগোনা তাকে পরীক্ষার ফলাফলের টেনশন দূর করে দিল। সাথে তার মায়ের কড়া ভাষণের কথাগুলোও। এরপর ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে এসে সে নিজেই চা টা গরম করে বিস্কুট নিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলো।
এই সময়ই শ্রীলতার বাবা দিপক্ বাবু প্রবেশ করলেন । দীপক বাবু পেশায় একজন প্রাইভেট কম্পনিতে চাকুরী করেন। মাইনে খুব বেশি পান না। কিন্তু শ্রীলতা কে কোন অভাব তিনি বুঝতে দেন না। বই- খাতা-পেন যখন যা দরকার বলা মাত্রই এনে দেন। তার একমাত্র ইচ্ছা শ্রীলতাকে সে ডাক্তার করবে। বাবার স্বপ্নের কথা ভাবলেই শ্রীলতার ছোট্ট হৃদয়টায় একটা উষ্ণ বায়ুর স্রোত খেলে যায়।
-শ্রী, এবছর তো তুই ক্লাস নাইনে উঠবি। আমি একজন ভালো টিচারের সন্ধান পেয়েছি। ভাবছি সেখানে তোকে ভর্তি করবো।
-ও হ! আচ্ছা। কি কি সবজেক্ট পড়ান উনি?
-বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল।
-আর্টসের সাবজেক্ট গুলো তাই তো?
-হুম। আমায় একজন বললেন উনি খুব ভালো ভালো নোটস দেন। অনেক স্টুডেন্ট সেখানে পড়ে। ওটা তো একটা কোচিং সেন্টার তাই শুনলাম ভিড়ও মন্দ হয় না। তোর কোনো অসুবিধা হবে না তো?
শ্রীলতা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে বলে, না না। সমস্যা কিছু নেই। তবে আমার বান্ধবী শ্রেয়াও তো একজন ভালো টিচার এর খোঁজ করছিল। ওকে বলে দেখবো?
-তাহলে তো ভালো ই হয়। দু- জনে একসাথেই যাবি।
-আচ্ছা, তাহলে শ্রেয়াকে বলে দেখবো। কিন্তু স্যারের কি নাম? কোথায় বাড়ি বললে না তো?
-রবিন চক্রবর্তী। রথ তলার মোড়েই ওনার বাড়ি।
-ওহ! ওনার কথাই তো শ্রেয়া আমায় বলছিল।
-ঠিক আছে তাহলে শ্রেয়া কি বলে দেখ।
দিপকবাবু এইটুকু কথা বলেই স্নানের জন্য বাথরুমে র দিকে এগোলেন। সকাল নয়টার ট্রেন ধরে তাকে কাজে বেরোতে হয়। তার আগে সকাল বেলা উঠেই তিনি বাজার যান। শ্রীলতা দিপকবাবুর একমাত্র কন্যা। একমাত্র সন্তান ও বটে। মেয়ে হয়েছে বলে তার মনে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। বরঞ্চ এই মেয়েকে নিয়েই তিনি অনেক স্বপ্ন দেখেন। আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় দ্বিতীয় সন্তানের কথাও কখনো মাথায় আনেন নি।
চলবে...
ছবি : সংগৃহিত
4 মন্তব্যসমূহ
Darunn golpo ta khub sundarrr
উত্তরমুছুনdhonno baad, porer porbo gulo porben porbo aste thakbe.
মুছুনভিষন ভালো গল্প টা। খুব সুন্দর।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ পরের পর্ব গুলো পড়ার অনুরোধ রইলো।
মুছুন