নীরবে ভালোবাসি - পর্ব-২
শ্রীলতার এখন স্কুল ছুটি । হাতে অনন্ত সময়। কাজেই সে চা খেয়ে বেসিনে নিজের কাপ প্লেট খানা ধুয়ে , রান্না ঘর থেকে ডাল, ভাত, তরকারি, মাছ সাজিয়ে টেবিলে রেখে তার বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। বাথরুম থেকে ভিজে গামছায় চুল গুলো শেষ বারের মতো মুছতে মুছতে দীপক বাবু বেরিয়ে এলেন । গামছা খানি ঘরের লাগোয়া একফালি উঠোনে টাঙানো তারে মেলে দিয়ে চৈতি র উদ্যেশে তিনি হাকার দিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে বললেন কই গো? রান্না হলো?ট্রেনের সময় হয়ে গেছে তো! যতটুকু যা হয়েছে তাই দাও। বলতে বলতে দীপক বাবু তাড়াহুড়ো করে চুলটা কোনোমতে আচড়ে, জামা, প্যান্ট পরে টেবিলে এসে বসতেই দেখে, শ্রীলতা বসে আছে ভাতের থালা সাজিয়ে।
-এতটুকু মেয়েকে দিয়ে কি কেউ ভাত বাড়ায়?চৈতি , তুমি দেখছি আমার মেয়েকে এই কয়েকদিনে সাংসারিক কাজ শেখাতে বড় বেশী উদ্ধত হয়ে উঠেছো। সে সবের অনেক বয়েস আছে। এখন থেকে এইসব কাজে ওকে নাই বা ভার দিলে।
চৈতি, মানে শ্রীলতার মা তখন রান্নাঘরে দীপক বাবুর ই লাঞ্চ বক্স এ রুটি, তরকারি ভরে দিচ্ছিলেন, তার কথা গুলো কানে এসে বেঁধা মাত্রই সশব্দে টিফিন বক্সের ঢাকনাটা বন্ধ করে, হাত দু-খান কোনমতে ধুয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে তীব্র ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন, কি বললে ? আমি ওকে সংসারের কাজ করতে বলি?ওতো সামনেই বসে আছে, ওকেই জিজ্ঞাসা করো না আমি ওকে ভাতের থালা সাজিয়ে আনতে বলেছিলাম, নাকি ও নিজে থেকেই পাকামো করে এনেছে।
ঘরের আবহাওয়া গরম বুঝতে পেরে দীপক বাবু ভাতের থালায় মনোসংযোগ করলেন এবং একবার আড় চোখে শ্রীলতার দিকে তাকালেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই শ্রীলতা কিছু বলতে চাইলো- কিন্তু তার চোখের ইশারা দীপক বাবু বুঝতে পারলেন না। অন্যসময় হলে হয়তো বুঝতে পারতে ন, কারণ বাপ- বেটি তে অনেক সময় মা কে আড়াল করে এইভাবেই কথপোকথন সেড়ে নেয়। দীপকবাবু আসলে মেয়ে অন্ত প্রাণ।আর শ্রীলতারও যত আবদার, আহ্লাদ তার বাবার কাছে। আর দীপক বাবুও মেয়ের সবটুকু ইচ্ছে, চাওয়া-পাওয়াকে তার সবটুকু সাধ্য মতো পূরণ করার চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে শ্রীলতা বাবা কে বলতে এসেছিল তার ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে। রিচার্জ করে দেওয়ার জন্য। এই রিচার্জ করার প্রসঙ্গটা টা শুনলেই যে তার মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে এই ব্যাপারে শ্রীলতা নিশ্চিত। তাই ভাতের থালা সাজিয়ে আড়ালে-আবডালে তার বাবাকে বলার তালে সে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বাবা ইএখন এমন ভাবে তার মা কে তাতিয়ে দিয়েছে তাতে তো মনে হচ্ছে সহজেই এখান থেকে নড়বে না। গজগজ করতেই থাকবে। আর শ্রীলতার ও রিচার্জ করে দেওয়ার কথাটা হয়তো আজ তার বাবাকে শেষমেশ বলা হয়ে উঠবে না। ফোন টা কিন্তু শ্রীলতার নিজস্ব নয়। ওর স্কুলের অনেক বন্ধু- বান্ধবী দেরই পার্সোনাল ফোন আছে। শ্রীলতারও মাঝে মাঝে নিজের একটা পার্সোনাল ফোনের শখ হয়। কিন্তু ও জানে ওর বাবার মাইনে খুবই কম। কোনোরকম বাড়তি বিলাসিতা ছাড়াই তাদের সংসার চলে। সংসারের অত্যাবস্যক নিত্যনৈমিত্তিক জিনিস পত্তর ছাড়া সে কোনোদিন দেখে নি তার মাকে কোনো শখের জিনিস কিনতে। গেল বছর শীতের মেলা তে পাশের বাড়ির সব কাকিমা-জেঠিমা-বৌদির সাথে শ্রীলতা ও তার মাও গিয়েছিল। তারা যখন নতুনত্ব ডিজাইনের সোয়েটার , চাদর কিনছিল ; শ্রীলতা স্পষ্ট দেখেছিল তার মায়ের আত্মত্যাগ। সোয়েটার গুলোতে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল দোকানির হাতে।
- বৌদি নিতে পারেন, লেটেটেস্ট ডিজাইন আছে। মার্কেটে খুব চলছে সোয়াটার গুলো। আপনার বয়সী মহিলাদের বেশ মানাবে। খুব সেল হচ্ছে। দেখুন না, আপনার সামনেই পাঁচ পিস বিক্রি হয়ে গেল।
দোকানি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মুখে আলগা হাসির রেশ টেনে চৈতি বলেছিল , না ভাই লাগবে না। এই আলগা হাসির পিছনে যে কত বড় কষ্ট, ফিরিয়ে দেওয়ার যন্ত্রনা লুকিয়ে আছে তা শুধু শ্রীলতাই বুঝতো।
এ জীবনে ফিরিয়ে দিতে দিতে তার অন্তরে কষ্ট টা হয়তো পাথর হয়ে অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু শ্রীলতা যে তার মেয়ে। নাড়ি ছেড়া ধন। তার মায়ের প্রতিটা হাসি, কান্নার আসল পরিমাপ যে কতখানি গভীর তা সে বোঝে। আর অভাবের সংসারে জন্ম হয়েছে বলেই হয়তো এই সকল অনুভূতি গুলো সে নিমিষেই বুঝতে পারে।
তাই বাড়ির ফোনের ব্যালেন্স ই যখনই শেষ হয়ে যায় স্বাভাবিক ভাবেই চৈতির খারাপ লাগে। তার কাছে এইগুলো ফালতু খরচ ছাড়া আর কিছু না। চৈতি তো বাড়ির ফোন টাই কিনতে চায় নি। দীপক বাবুকে বলেছিলেন কি দরকার বাড়তি একটা ফোনের? তোমার কাছে তো একটা ফোন আছেই।
-তা বললে হয় চৈতি...এই আমি বাইরে কাজে যাই, ট্রেন-বাসের হটাৎ গন্ডগোল করলে ফোন করে বলে দিলে তুমিই তো নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।
-হ্যা, গো বাড়ির লোক বাইরে থাকলে শুধু মাত্র ফোন করে দিলেই কি নিশ্চিন্তে থাকা যায়? আর তাছাড়া, তুমি কোনো অসুবিধায় পড়লে তো পাশের বাড়ির ঐশী দের বাড়ি ফোন করে তো জানিয়ে দাও। ওতেই হবে। একটা ফোনের তো অনেক দাম । শুধু শুধু অতগুলো টাকা খরচ করার কোনো মানে হয়? মেয়ে বড়ো হচ্ছে। সেসব খেয়াল রেখেছো? গয়না গাটি কিছুই আমার তেমন নেই। অন্তত হাতের-গলার-কানের না গড়াতে পারলে কি মানান দেখাবে?
-উফঃ চৈতি তোমায় নিয়ে আর পারা গেল না। কি বলতে এলাম, আর তুমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে কোথায় নিয়ে গেলে। এখন সব বাড়িতেই দুটো করে ফোন আছে। এটা বিলাসিতা কেন মনে করছ? এটা খুবই দরকারি এখন কার দিনে।
দীপক বাবু যখন চৈতি কে কথা গুলো বলছিলেন শ্রীলতা তখন পাশের ঘরে পড়ছিল। ফোন কেনার কথা শুনতে পেয়েই একলাফে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে ছুটে এসে উপস্থিত হলো।
-বাবা, তুমি বাড়ির জন্য একটা ফোন কিনবে?তাহলে এন্ড্রয়েড ফোন কিনবে বাবা প্লিজ।
-কি এন্ড্রয়েড? সে তো বড় ফোন, ওতে নাকি ছবিও তোলা যায়! না না! ওতো দামি ফোন কিনতে হবে না। ফোনে কথা বলা নিয়ে দরকার। একান্তই যখন কিনবেই মনস্থির করেইছো যখন সাধারণ ফোনই কেন।
তৎক্ষণাৎ শ্রীলতার মুখ টা কালো হয়ে গিয়েছিল। সে তার মাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই আর বায়না কিংবা তর্ক না করেই মুখ নিচু করে পুনরায় পাশের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
-শ্রী, কাল কাজ থেকে ফিরে তোকে নিয়ে ফোন কিনতে যাবো। রেডি থাকিস সন্ধে বেলা। এন্ড্রয়েড ফোনই কিনবো।
ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে শ্রী প্রায় দরজার কাছে চলেই এসেছিল।
বাবার বলা কথাটা কানে আসতেই ম্যাজিকের মতো শ্রী এর মুখে খুশির ঝলক খেলে গেল। চোখের জল মুছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল সত্যি বাবা, আমার তো বিশ্বাস ই হচ্ছে না।
-হ্যা, রে মা, তোর যখন ইচ্ছা তখন আমি কি আর না করতে পারি?
ওহ! কদিন পর মেয়ে বায়না ধরবে বাবা আমায় আমেরিকা শহর টা কিনে দাও। তুমি তাহলে তাই কিনে দেবে তাহলে?
চৈতি র কথা শুনে শ্রী এর খুব রাগ হয়। অভিমানে বাবাকে জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা গুঁজে বসে।দীপক বাবু হো হো করে অকস্মাৎ হেসে ওঠে।তার হাসির উদ্ভট আওয়াজে শ্রী, চৈতি দুজনেই চমকে যায়। শ্রী মুখ তুলে বাবার দিকে কৌতূহল এর দৃষ্টি তে তাকায়।চৈতি ও ভ্যাবাচেকা হয়ে জিজ্ঞাসা করে এমন বিশ্রীভাবে হাসার কারণ টা কি হলো শুনি?
দীপক বাবু হাসি থামিয়ে বলেন, আমার মেয়ে ঐরকম বুদ্ধিগত দিক থেকে আবনর্মাল নয় যে , আমার কাছে ঐরকম অদ্ভুত আবদার করবে।তাই তোমার কথা শুনে হাসি পেলো। বাবার হাসির কারণটা প্রকাশ হতেই শ্রীও আড় চোখে তার মা কে দেখে মুচকে হেসে ফেলে।
চৈতি একবার দীপকের দিকে ও একবার শ্রী এর দিকে কটমট করে তাকিয়ে মেঝে তে পা রগড়ে গটগট করে ঘরের বাইরে চলে গিয়েছিল।
তারপরের দিনই চৈতির উপদেশ কে অমান্য করেই দীপক বাবু ও শ্রী গিয়ে এন্ড্রয়েড ফোন কিনে এনেছিল। সেই থেকে ফোন আসা - যাওয়া ছাড়া আর ফোন টা কোনো কাজেই লাগায় নি চৈতি। কিন্তু শ্রী এর এতে বেশ সুবিধা হয়। প্রথম কয়েকদিন নতুন ফোন পেয়ে বিস্তর সময় সে ফোনে গেম খেলতো। চৈতির কোনো শাসন, চোখ রাঙ্গা নিকে সে তোয়াক্কা করতো না। নতুন ফোন হাতে পেলে যা হয় আর কি! বন্ধু- বান্ধবী দের সাথেও ফোনে, ম্যাসেজে ফালতু সময় নষ্ট করে অকাজের গল্প করত।
- ওতো ক্ষণ ফোনে গল্প করলে ফোনের ব্যালেন্স টা ফুরায় না বুঝি?
- মা, ফোন টা শ্রেয়া করেছে। কাজেই ওর ব্যালেন্স ফুরোচ্ছে আমার নয়।
- কিন্তু ইলেকট্রিক টা তো ফুরোচ্ছে। এত কথা বললে, ফোন ঘাটলে চার্জ তো তাড়া তাড়ি শেষ হবে। মাসে কত টাকা করে ইলেকট্রিক বিল আসে জানিস?
অগত্যা মায়ের কথার কাছে তাকে নতিস্বীকার করতে হয়।
তারপর দীপক বাবু অফিস থেকে ফেরার পর ফোনের অপব্যবহার সম্পর্কে শ্রী এর নামে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য দিতে ভোলেননি চৈতি। স্ত্রী এর মুখ থেকে শ্রী এর কার্য কলাপ সম্পর্কে ধারণা পেয়ে কিন্তু তিনি শ্রী কে কোনো অংশই প্রশ্রয় দেন নি। এমনকি বকাবকি ও করেন নি। বরঞ্চ বুঝিয়েছিলেন সময়ের সদ ব্যবহার কিভাবে করতে হয়। অবাঞ্চিত ফোনে কথা বলা কিংবা মেসেজ এ ব্যস্ত থাকলে দু বন্ধুরই ক্ষতি এইসব ইতিবাচক, ন্যায় সঙ্গত কথা গুলো রূঢ় ভাবে না বুঝিয়ে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছিলেন দীপক বাবু। ফলে শ্রী এর ক্ষেত্রেও নিজের ভুলটা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি। তবে বন্ধুদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্যও যে নূন্যতম ব্যালেন্স এর অবশ্য দরকার সেটুকুও চৈতি বুঝতে চাইতো না। কাজেই চৈতিকে এইসব ব্যাপারে শ্রী অনেকটাই এড়িয়ে চলতো।
কিছুক্ষন ইতস্তত করেও যখন দীপক বাবুকে বোঝাতে শ্রী ব্যর্থ হলো, তখন সে অন্য পথ অবলম্বন করার চেষ্টা করলো। মনে মনে ভাবল যে করেই হোক মা কে এখন এখান থেকে সরাতে হবে। নাহলে তার কার্য সিদ্ধি হওয়া মুশকিল আছে।
-মা, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে, বাবার জন্য আর এক পিস মাছ নিয়ে এসো তো।
-না, না! এই ঢের। কাজে বেরোনোর সময় কি ওতো সময় থাকে মাছ বেছে খাওয়ার। না, চৈতি আনতে হবে না।
শ্রী তো আকাশ থেকে পড়লো। এবার উপায়?
তবু সে শেষ চেষ্টা করার ত্রুটি রাখলো না।
-আমি কাঁটা বেছে দিচ্ছি। খাও তো। শ্রী এর মাছ খাওয়ানো র এই পীড়া পীড়ি টা এবার বেশ অবাক করলো দীপক কে। তিনি এতক্ষন ভাতের থালার পানে চেয়েই খেতে খেতে কথা বলছিলেন। এবার শ্রী এর দিকে চেয়ে চৈতি কে হুকুম করলেন, -আমার শ্রী, মা যখন বলছে, তাহলে আর এক পিস না হয়...
দীপক বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই চৈতি হন্তদন্ত হয়ে মাছ আনতে রান্নাঘরে গেলেন।এই ফাঁকেই শ্রী কে ঠেলা দিয়ে দীপক বাবু হাতের ইশারা করে জানতে চাইলেন কি আবদার শুনি?
শ্রী মৃদু স্বরে বললো বাবা, ফোনের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেছে...
কথা টা শেষ হওয়ার আগেই পুনরায় ইশারায় দীপক বাবু ঘাড় হেলিয়ে বললেন, বুঝেছি। শ্রী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। অবশেষে বলা গেল, এই ভেবে।
-এই নাও, পেটির দিকটা দিলাম। যাতে কাঁটা ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি খেতে সুবিধা হয়।
দেওয়ালে সজ্জিত ঘড়ির কাঁটা গুলোর দিকে তাকিয়ে দীপক বাবু বললেন, আর সময় নেই। তুমি বরঞ্চ আর একটু ভাত, ডাল, তরকারি আনো। শ্রী কে বরঞ্চ দুটো গরম ভাত দাও। মাছের পেটিটা দিয়ে ও খেয়ে নিক।
-কি আশ্চর্য রে বাবা! এই বললো খাবো। আবার বলছে সময় নেই। শ্রী কে ভাত, তরকারি দাও।আমি ঐ করি আর কি...
বেরোনোর সময় আর গজগজ করতে প্রবৃত্তি হলো না চৈতির। তাই একরাশ বিরক্তি নিজের মধ্যেই সংবরণ করে শ্রী এর জন্য আবার ভাত, তরকারি আনতে যাচ্ছিলেন, শ্রী ই তাকে বাধা দিয়ে বলল,
-মা, আমিই নিয়ে নিচ্ছি। তুমি বরঞ্চ বাবার লাঞ্চ বক্স, জলের বোতল এইসব ব্যাগে ভোরে দাও। সত্যিই আজ অনেকটা লেট হয়ে গেছে বাবার। এই ট্রেন টা ভালোয় ভালোয় পেলে হয়।দীপক বাবু একটি লেদের কারখানায় কাজ করেন। দৈহিক পরিশ্রমের কাজ। খাটুনি অনুযায়ী মাইনেও খুব কম। তাছাড়া যাতায়াত খরচও নেহাত কম নয়। বাড়ি থেকে আট টা স্টেশন পেরিয়ে কর্মস্থল। স্টেশন থেকে নেমে অটোয় যেতে হয়। দীপক বাবু অটো ভাড়া বাঁচানোর জন্য আগের ট্রেনটা তেই চলে আসেন। তারপর হেটে কারখানায় আসেন। ফেরার পথেও হেটেই স্টেশনে পৌঁছান। তাই বাড়ি ফিরতে ও রাত সাড়ে আট টা, নয় টা হয়ে যায়। ইদানিং তার হাঁটাহাঁটি করলে শরীরে কষ্ট হচ্ছে, হাঁফানি আসছে দ্রুত, তার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘাম ও হচ্ছে অতিরিক্ত। তাই মাঝেমাঝেই তিনি অটোয় উঠতে বাধ্য হন। আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেন পেয়েছেন তিনি। স্টেশনে পা রাখা মাত্রই ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকছে দেখে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু উঠতি বয়সী কিছু ছোকরার রুদ্ধশ্বাসের ছুট দেখে তিনিও মনে মনে বল পান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মনের মধ্যে পজিটিভ এনার্জি সঞ্চয় করে তাদের সাথেই পাল্লা দিয়ে তিনিও ছুটতে শুরু করেন। ছেলে গুলোর মতোই তিনিও ব্রিজে ওঠার সময় একটা -দুটো সিঁড়ি গ্যাপ দিয়ে কাঁধে থাকা টিফিন বক্স, জলের বোতল রাখার ব্যাগ খানা সামনের দিকে একহাতে চেপে ধরে দৌড়াতে থাকেন। ব্রিজ থেকে প্ল্যাটফর্মে পা রাখতে তখনো দুটো সিঁড়ি বাকি, ট্রেনটা হুইসেল দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কাকু, হয়ে যাবে চলে আসুন, চলে আসুন।
ছেলে-ছোকরা গুলোর এমন উৎসাহ মূলক মন্তব্যে তিনি শেষ চেষ্টা টা করলেন। ট্রেন ছেড়ে মৃদু গতিতে প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়েও যাচ্ছিল ছেলেরাই দীপক বাবুর হাত ধরে টেনে গাড়িতে তুললেন। ট্রেনে উঠেই দীপক বাবু দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন। হাত-পা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে শুরু করলো। নিঃশ্বাসের গতি-বিধি দ্রুত হতে থাকলো। তার শরীরের এইরকম অবস্থা দেখে ট্রেনের জানালার ধারে বসা একজন প্যাসেঞ্জার নিজে থেকেই উঠে বললেন,
-আরে, মশাই, আপনার যে শরীরটা খুবই খারাপ দেখছি। ঐভাবে কেউ চলন্ত ট্রেনে উঠতি বয়সী ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে ওঠে?
প্যাসেঞ্জার টির কথা শেষ হতে না হতেই সকলেই রে রে করে তার সাথে সহমত পোষণ করলো। দীপক বাবু তখনও কিছু বলার অবস্থায় ছিলেন না। তিনি জানালার ধারে বসে তখনও ক্রমাগত হাঁফাছিলেন। ছেলে গুলোই বললো
-কাকু আশা ছেড়েই দিয়েছি লেন। আমরাই বলতে ছুটে এসে আমাদের সাহায্যে উঠলেন। মিনিট দশেকের পরই জানালা দিয়ে আগত সকালের ফুরফুরে হাওয়া তার শরীর টাকে সতেজ করে দিলো। ট্রেন থেকে নেমেই তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন আজ অটো তেই যাবেন। এমনিতেই সকাল সকাল ঝুঁকি নিয়ে অতটা ছুটে বিস্তর নোনা জল শরীর থেকে ঝরেছে। যদিও শরীর টা এখন বেশ ঝর ঝরেই আছে। তবুও তিনি শরীর টাকে আর কোনো কষ্ট দিতে চাইলেন না। ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে চটপট প্লাটফর্ম বরাবর সোজা হাঁটতে লাগলেন অটোর উদ্যেশে। অন্যান্য দিন মিনিট খানেক দাঁড়ান , কারখানার অন্যান্য কর্মচারী দের সাথে হেটে যাওয়ার জন্য। আজ প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে অটো র লাইনে দাঁড়ালেন। সকাল বেলা প্যাসেঞ্জার যেমন থাকে, তেমন অটো ও থাকে অনেক। সুতরাং দীপক বাবুকে বেশিক্ষন লাইনে অপেক্ষা করতে হলো না। অটোয় চেপে বসলেন। কিন্তু অটো স্টেশন রোড এর রাস্তা ঘুরিয়ে কারখানার রাস্তার দিকে বেঁকতেই তার নজরে পড়লো কারখানার কর্মচারী রা দ্রুত গতিতে আড্ডা দিতে দিতে হাঁটছে। তাদের দেখেই তার মনটা আবার অস্থির হয়ে উঠলো।
-ইস! হেটে গেলেই হতো। ফালতু এই টাকাটা নষ্ট হলো। একটু হয়তো কষ্ট হতো, তা নাহয় কারখানায় পৌঁছে মিনিট দশেক রেস্ট নেওয়াই যেত। কারখানায় পৌঁছে সবাইতো জামা ছেড়ে, ঝুল-কালি ওয়ালা কাজের ড্রেস পড়তে, জল খেতে মিনিমাম দশ মিনিট সময় তো ব্যয় করেই থাকে। ওই অটো খরচের টাকাটা থাকলে বরঞ্চ ফেরার পথে ট্রেন থেকে নেমে পাড়ার বিশু ময়রার দোকান থেকে একটু মাখা সন্দেশ নিয়ে গেলে বেশ ভালো হতো। শ্রী খেতে খুব ভালোবাসে।
(চলবে)
ধারাবাহিক টি ভালো লাগলে অবশ্যই একটা কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ রইলো। অবশ্যই শেয়ার করতে পারেন।
ছবি : সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ