হাসপাতালের সেই রাত( প্রথম পর্ব)

 

that night in the hospital first part


হাসপাতালের সেই রাত( প্রথম পর্ব)


আমার পুত্রসন্তান জন্মানোর প্রায় ছয় মাস পর থেকেই হটাৎ পেটে অসম্ভব যন্ত্রনা হতে শুরু করে। সাথে বমিও। কিন্তু বাচ্চা  তখন ও ব্রেস্টফিডিং করতো তাই নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া ও কম মসলাযুক্ত, প্রোটিন খাবারই খেতাম। তবুও মাঝে মাঝেই আমায় এই সমস্যার সম্মুখীন হতো হচ্ছিলো। প্রথম দিকটা ভেবেছিলাম হয়তো হজম জনিত সমস্যার জন্য গ্যাস, অম্বল হচ্ছে। কিন্তু গ্যাসের ওষুধ খেয়েও কোনো উপশম বোধ হতো না। কোনো কোনো দিন রাতবিরেতে যন্ত্রনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়াতে বাচ্চাকে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে রেখেই হাসপাতালে যেতে হতো ইনজেকশন নেওয়ার জন্য। ইনজেকশন পুশ করার ঘন্টা খানেক পরই অবশ্য আরাম বোধ করতাম।দুইমাসের মধ্যেই এইভাবে বার চারেক বাড়াবাড়ি হওয়ায় হাসপাতালে এসে ইনজেকশন নেওয়াতে ডাক্তার বাবুই পরার্মশ দিলেন পেটের অল্ট্রাসনোগ্রাফি টা করিয়ে নিতে।শুনেই তো আমার মনের ভিতর নানানরকম ভয়ের উদ্রেক হতে থাকলো। একবার মনে হচ্ছিল অল্ট্রাসনোগ্রাফি করবো না। আবার খানিক পরেই মনে হতে লাগলো না ! এতবার যখন এইরকম হচ্ছে তখন পরীক্ষাটা করে নেওয়াটাই শ্রেয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমার বাপের বাড়ি গোবিন্দপুর এ। গ্রাম্য এলাকা। সেখানে রাতবিরেতে চটজলদি ডাক্তার পাওয়ার সম্ভবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই ইমারজেন্সি অবস্থায় আমায় মানপুকুর( কাল্পনিক নাম) হাসপাতালে আসতে হতো। এদিকে আমার বাপের বাড়ির দূরত্ব মানপুকুর  হাসপাতাল থেকে হাঁটা পথে মাত্র দশ মিনিট। সুতরাং এইরকম দুরবস্থায় আমি কিছুদিন ছেলে কে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এইসময়ই ডাক্তারের নির্দেশ মতো অল্ট্রাসনোগ্রাফি টাও সেরে ফেললাম। দিন তিনেক পরেই রিপোর্ট দেখে আমার দু চোখে অন্ধকার নেমে এলো। গলব্লাডার স্টোন। এবং স্টোনটি আকারে অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে। তাৎক্ষণিক অপারেশন করাটা খুবই জরুরি বলে ডাক্তার জানালেন। আমি পড়লাম অথৈ সাগরে। এতটুকু ছেলেকে রেখে হাসপাতালে অপারেশনের জন্য কমপক্ষে তিনদিন থাকার কথা আমার কাছে কল্পনারও অতীত। ভাবলেই চোখে জল আসছিল। ও তখনও ব্রেস্টফিডিং করতো। আমার নিজের অপারেশন এর জন্য তখন কোনো ভয়ের সৃষ্টি হয় নি। আমি শুধু ভাবছি আমার ছেলেটার কি হবে। সরল, নিষ্পাপ চোখ দুটো যে শুধু আমাকে খুঁজবে। ওর কান্নামখা, নিরলস মুখখানির দৃশ্যই তখন আমার মানসপটে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমার স্বামী বেসরকারি চাকুরী জীবী। সুতরাং অপারেশনের সময় পরপর তিন দিন ছুটি নেওয়াও সম্ভব ছিল না। সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতেই অপারেশনের দিন এগিয়ে এলো। আমার শাশুড়ি মা, শশুর মশাই মন থেকে সাহস জোগাচ্ছে ততদিনে। ঠিক হলো অপারেশনের দিন গুলিতে আমার ছেলে তার মামারবাড়ি অর্থাৎ আমার মা, বাবার কাছেই থাকবে। আর স্বামী অপারেশন এর দিনই শুধু কোনোক্রমে ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছিল। অপারেশন ছিল ষোল ই জানুয়ারি শুক্রবার। শীতকাল। আমি আগের দিনই ভর্তি হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার সময় ছেলেকে রেখে যেতে এতটাই কষ্ট হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ছেলেকে আমার মায়ের কোলে দিয়ে তার গালে স্নেহের চুম্বন এঁকে চোখের নোনতা ধারার স্রোত টাকে কোনোমতে দমিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমি চেষ্টা করেছিলাম যাতে অপারেশনের দিন সকাল বেলা ভর্তি হতে পারি। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরাসরি আমার এই অনুরোধ নাকচ করে দেন। তাদের বক্তব্য ছিল অপারেশনের আগের দিন ও ডাক্তারদের পরার্মশ মতো তাদের কিছু রুলস মেন্টেন করতে হয়। বাস্তবিকই কথাটা যথার্থই ন্যায্য। অগত্যা অপারেশনের আগের দিনই আমায় ভর্তি হতে হয়েছিল। সেখানে আমায় নিয়ে গিয়েছিল আমার বাবা। হাজব্যান্ডকে ওইদিন অফিসে যেতে হয়েছিল। বেলা বারোটা নাগাদ আমায় কতৃপক্ষ নির্দিষ্ট বেড দিলো। আমার বাবা দরকারি কাগজ পত্রে সই সাবুদ সেরে আংশিক বিল মিটিয়ে ফিরে গেলেন। বেডে গিয়ে বসা মাত্রই আমার মনের গভীরে জমা ভয়ের জালগুলো আস্তে আস্তে কেটে গেল। নানান রকম বয়সের রুগীর মুখ আমার সামনে ভেসে উঠলো। কারো বয়স আট তো কারো বয়স আশি। আমার পাশেই একজন ভদ্রমহিলা বসে ছিলেন সাথে তার দশ বছরের ছোট ছেলে। ভদ্র মহিলাটি আমায় দেখামাত্রই যেচে আলাপ জুড়িয়ে দিলেন। আমিও সৌজন্য বিনিময় সারলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম ওনার ছেলেরও গলব্লাডারে স্টোন হয়েছে। ছেলের অপারেশনের জন্যই আসা। এখানে আসার আগে অবধি আমি ভাবেছিলাম আমার বয়স মাত্র পঁচিশ। সবে মাত্র ছেলে হয়েছে। এই বয়সেই স্টোন ধরা পড়লো। কিন্তু এই পরিবেশে পা রেখে আমার চিন্তাধারা আমূল বদলে গেল। এটুকু বাচ্ছা রও স্টোন হতে পারে? ছেলেটার জন্যও তার মায়ের জন্য আমার অন্তর আত্মা টা কেঁদে উঠলো। ছেলেটার নাম ছিল আকাশ পাল। যাইহোক ওদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে কখন যে ঘন্টাখানেক সময় পেরিয়ে গেছে দুপক্ষের কেউই খেয়াল করি নি ।এখানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অনুমতি নেই। তাই চাইলেও আমার ছেলের গলার কণ্ঠস্বর টাও আমি শুনতে পাব না।তাই নিজেকে যাতে নিঃসঙ্গ না মনে হয় তাই আসার সময় দুটো বাংলা ম্যাগাজিন বই কিনেছিলাম। কিন্তু ওদের সাথে কথা বলতে বলতে মনে হল বই দুটির মনে হয় বিশেষ প্রয়োজন হবে না। 

"আপনাদের লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে" একজন আয়া এসে ভারী গলায় কথাটা বলেই ব্যস্ত হয়ে বাইরে চলে গেলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে খাবার ভর্তি ঠেলা গাড়ি ও চলে এলো। আকাশেরও আগামীকাল অপারেশন। ওকে বেশ প্রাণচঞ্চল, ও হাসিখুশী ই লাগছিলো। আসলে বাচ্ছা ছেলে। ওর অবুঝ মনে ভয়, ডোর এর কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। তাছাড়া মা পাশে থাকায় ওর মনে কোনো আশঙ্খা না জন্মানোই স্বাভাবিক। ওর মিষ্টি মুখের পানে চাইতেই যে আমার বাচ্ছা টা র কথা মনে পড়ে বুক টা হু হু করছিল সে কথা বলাই বাহুল্য। দেখলাম মা, ছেলে দুজনকেই   খাবার দিলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগলো আমার। কিন্তু ভোজন পর্ব শেষ হওয়ার পরই কর্তৃপক্ষ এর অফিস কতৃক নোটিশ এলো আকাশ পালের গার্জেনকে তার পাশে থাকতে দেওয়া যাবে না। কারণ তার বয়স সদ্য দশ পেরিয়ে গেছে। নিয়মানুযায়ী দশ বছরের ঊর্ধে হয়ে গেলে আর গার্জেনকে আলাউ করা হয় না।

চলবে...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহীত


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ