ষড়যন্ত্রের শিকার (তৃতীয় পর্ব)
এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই গীতাদেবী ডুব দিলেন আরও অতীতের দিনগুলিতে । ফিরে গেলেন বেশ অনেক গুলো বছর আগের ঘটনায়।
গীতা দেবী তখন সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। রক্ষণশীল , গোড়া, একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। পরিবারের কর্তা দাদামশাই কে সকলে সন্মান করতেন। বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্য তাঁকে মান্য করতেন। সেই বাড়িতে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। তাঁর কথা মতোই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা উর্তীর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই গীতা দেবীর বিবাহের জন্য পাত্র দেখার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।এই বাড়ির মেয়েদের কলেজ যাওয়ার অনুমতি মেলে না। তাই স্কুলের গন্ডি পার করার সাথে সাথেই গিতার আরো যে সকল কাকাতুতো, জ্যাঠ তুতো দিদি রা ছিল তাদের সকলের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী গিতাদেবী জেদ ধরে বসলেন সে কলেজে ভর্তি হবেই। পরিবারের সকলের অমত থাকা সত্বেও এক প্রকার জোরপূর্বক সে কলেজে ভর্তি হয়। এরফলে বাড়ির গুরুজনদের সাথে তার মনোমালিন্য শুরু হয়। সৃষ্টি হয় মনের দূরত্বও।
যে বছর সে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল সেবছর ই তাদের কলেজ থেকে একটি অনাথ আশ্রমকে সাহায্যের জন্য তাদের বেশ কয়েকজন ছাত্র, ছাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই প্রথম গীতা দেবীর সাথে অশোক বাবুর সাক্ষাৎ। তিনি তখন বিভিন্ন আশ্রম, এন.জি.ও ওর সাথে নানা জনকল্ল্যান মূলক কাজে জড়িত ছিলেন। প্রসঙ্গত পিতৃ, মাতৃহীন অশোক বাবু অনাথ আশ্রম থেকেই বড়ো হয়েছিল। তাই অনাথ আশ্রম গুলির সাথে ছিল তার আত্মিক সম্পর্ক। ব্রাহ্মণ ঘরে জন্ম হওয়ায় পিতৃপরিচয়হীন অশোক বাবুর সাথে বিয়ে দিতে গীতা দেবীর বাড়ি থেকে ছিলো নারাজ। দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্ককে উপেক্ষা করে অন্য কোন পাত্রের কন্ঠে মালা পরাতেও তখন সদ্য যৌবনে পরিপূর্ণনা গীতা দেবীর মন সায় দেয় নি। তাই মা বাবা , পরিবারের সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করে অচিরেই সে চলে এসেছিল অশোকবাবুর ঘরে। অশোকবাবু কে জীবনসঙ্গী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন।
প্রথম দিকে জিবিকানির্বাহ এর জন্য অশোক বাবু একটি দোকানে কাজ করতেন। আর্থিক সংকট থাকলেও গীতা দেবী খুব সুন্দর ভাবে ম্যানেজ করে নিতেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী অশোক বাবু কিছুদিনের মধ্যেই একটি দোকান ভাড়া নিয়ে নিজে কাপড়ের দোকান খোলেন। আস্তে আস্তে মাত্র দেড় কাঠা জায়গার ওপর একটি নিজস্ব দু কামরার ছোট বাড়ি করেন। ইতিমধ্যেই গীতা দেবী অন্তঃসত্ত্বা হন। তখন অশোক বাবুর কাপড়ের ব্যবসা আরো উন্নত হয়। শিলিগুড়ি শহরে পাকা রাস্তার ধারে তুলনামূলক ভাবে বেশ একটি বড়ো দোকান ঘর কেনেন তিনি। তাদের দুজনের সংসারে ঘর আলো করে অর্কের জন্ম হয়। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল বেশ সুখের। তাকে ঘিরেই তখন তাদের স্বপ্ন আশা-আকাঙ্ক্ষা । অর্কের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই অশোক বাবু আরো মন প্রাণ দিয়ে ব্যবসায় মেতে ওঠে। দোকানটাকে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় সেইসব ভাবনাতেই তিনি সারাটা দিন ব্যস্ত থাকতেন। গীতা দেবীর মনে পরে যায় বিচ্ছেদের শেষ দিন গুলি তে মাঝে মাঝেই অশোক বাবুকে বেশ আনমনা ও উদ্বিগ্ন লাগতো। তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে কোন ঠিকঠাক উত্তর দিত না । শুধু বলতেন আজকাল প্রোমোটারদের যা দৌরাত্ম্য বেড়েছে তাতে ব্যবসা চালানোই দায়। যেনতেন প্রকারে তারা আমার তৈরি দোকান টাকে কিনে নিতে চায়। সেখানে নাকি তারা বড় বিল্ডিং তৈরি করবে। ওরা অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে পাকা রাস্তার ধারে ওই দোকানটা যদি আমি ওদের কাছে বিক্রি করি তাহলে মোটা টাকাও দেবে আবার নিচের ফ্লোরে এখনকার মতো দোকান বসা তেও দেবে। কিন্তু আমি ওসব এ রাজি হই নি। ওসব প্রমোটারী চক্করে নিজের ব্যবসার অংশটুকু তুলে দিয়ে কোন ঘোরতর ফ্যাসাদে পড়তে আমি চাই না। আমার যেমন ব্যবসা চলছে তাতেই আমি খুশি।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই অর্ক নিদ্রা মিশ্রিত চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। মা হয়তো এখনো সেলাই মেশিনে বসে কাজ করছে। উফফ! মা কে শত বারণ করা সত্ত্বেও কিছুতেই কথা শুনবেনা। নিজের মুখে বিড় বিড় করে অর্ক বিছানা ছেড়ে নেমে ঘরের দরজাটা খুলতেই গীতা দেবীর ঘরের আলোটা তীব্র গতিতে ধেয়ে এসে তার ঘুমন্ত চোখে এসে বিধলো।
---মা !
আকস্মিক অর্কের গলার শব্দে গীতা দেবী চমকে বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলেন ।
-- কতবার বলেছি তোমায় এইভাবে রাত জেগে সেলাইয়ের কাজ করবে না। সকাল হলেই স্কুল, তারপর সংসারের কাজ এত কিছু সামলে রাত জেগে নিজের ক্ষতি টা ডেকে না আনলেই নয় তোমার ? খানিক টা ভৎসনার সাথে বলল অর্ক।
এতে তোমার চোখের ক্ষতি হবে। তাছাড়া এতক্ষণ ধরে একনাগারে বসে কাজ করার জন্য তোমার শিরদাঁড়ায় প্রেসার পরবে।
অর্কের বলা এক ঘেয়ে কথাগুলোকে কোনরকম আমল না দিয়েই ঈষৎ হেসে অর্কর দিকে চেয়ে গীতা দেবী বললেন সামনে দুর্গা পুজো তাই হাতে অনেক গুলো অর্ডার পেয়েছি। সময়মত সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে তো। তুই আবার এত রাতে উঠে এলি কেন? আমার কাজ হয়েই গিয়েছিল। ঘুম আসছিল না তাই একটু বসে ছিলাম। যা শুয়ে পর। আমিও এবার ঘুমাতে যাবো। আর হ্যাঁ, কাল বিকেলের দিকে তোর একটু সময় হবে?
কৌতূহলের সাথে অর্ক জবাব দিলো কেন বলো তো মা?
কাল ভাবছি ততে আর আমাতে মিলে একটু শপিং করব। তারপর বাইরেই ডিনার সেরে ফিরবো।
মায়ের গালে চকাস করে একটা চুমু দিয়ে পেছনদিক থেকে মায়ের গলাটা আকড়ে জড়িয়ে ধরে আদুরে সুরে অর্ক বলল গুড আইডিয়া মা। লাভ ইউ মা।
অর্কের মাথার ঝাঁকড়া চুল গুলোয় হাত বুলিয়ে গীতা দেবী নরম সুরে বললেন পাগল ছেলে আমার। এবার ছার আমায়। অনেক রাত হয়েছে। শুতে যা।
ওকে, গুড নাইট।
অর্ক চলে যাওয়ার পরেও বেশ অনেক রাত অবধি গীতা দেবী ঘুমালো না। আজ খুব বেশি করে তার স্বামীর কথা মনে পরছে। সে কখনোই তার স্বামীর মধ্যে কোনো উগ্র চাল চলন লক্ষ্য করে নি। বরঞ্চ স্ত্রী ও ছেলেকে আকড়ে ধরেই জীবন টা হাসি খুশিতে কাটাতে চেয়েছিল অশোক বাবু। শিলিগুড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়ও একবারও ওই জঘন্য ঘটনার সত্য তা জানার জন্য সুধাকর বাবুর বাড়ি গিতাদেবী যায় নি। সুধাকর বাবু তো নিজে এসে তাদের ঘরের আসবাবপত্র ভেঙে চুরে যান নি। কয়েক জন গুন্ডা টাইপের ছেলে সুধাকর বাবুর নাম করে এই ঘৃণ্ন কাজ করে তার স্বামী ও প্রভা দেবীর নামে কুৎসা রটিয়ে গিয়েছিল। আর পাড়ার মাতব্বর কিছু লোকেরা তাতে সায় দিয়েছিল। সেই অপমানের ই বশবর্তী হয়ে ঠিক ভুল কিছু না জেনেই সে ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনা ঘটার পনেরো দিনের মধ্যে গীতা দেবী বাড়ি বেচে কলকাতায় এসেছিল। সেই পনেরো দিনের ভিতরেও অশোক বাবু আসে নি । ফোন ও করে নি। তাই সরল সাধাসিধে গীতা দেবী তার স্বামীর এই অপকর্ম টা কেই সঠিক বলে মেনে নিয়েছিলেন।
চলবে....( আদেও কি অশোক বাবুর সাথে প্রভা দেবীর কোনো অবৈধ সম্পর্ক ছিল? নাকি এর পিছনে আছে গভীর কোনো চক্রান্ত? পরবর্তী পর্বই হবে অন্তিম পর্ব। সকলের সহযোগিতা একান্তই কাম্য।)
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ