ষড়যন্ত্রের শিকার (অন্তিম পর্ব)
অর্ক দেখতো, এই জিন্সের প্যান্টটা তোর পছন্দ হয়েছে কিনা ? লেটেস্ট ডিজাইন আছে। এটা পরে কিন্তু তোকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগবে।
-- মা তুমিও না!
--আরে বড়ো হয়েছিস, এই তো বয়েস এইসব জামা প্যান্ট পরার। আমি যেটুকু উপার্জন করি সবই তো তোরই জন্য। তোকেই যদি মনের মতো না সাজাতে পারলাম....
কথাটা পুরোটা শেষ করতে পারলো না গিতাদেবী। তার গলাটা ধরে এল। একটা অজানা সুখের নোনাজল তার চোখ ভোরে জ্বলজ্বল করে উঠলো । এ জল যে ব্যর্থতার নয়। আজ ছেলেকে সাধ্যমত পছন্দমত ব্র্যান্ডেড কোম্পানি প্যান্ট কিনে দিতে পারার আনন্দের কান্না।
গীতা দেবীর চোখে চোখ রেখে জিন্সের প্যান্টটা তার মায়ের হাত থেকে নিয়ে অর্ক জবাব দিল আমার খুব পছন্দ হয়েছে মা। তোমার দেয়া কোনো জিনিসই আমার অপছন্দ হয় না। ইনফ্যাক্ট আমার বন্ধুরাও বলে অর্ক তোর মায়ের কিন্তু চয়েস আছে।
হালকা ঠাট্টা করে গীতা দেবী অর্কের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন বন্ধুরা এ কথাটা বলে নাকি কোন স্পেশাল বান্ধবীর বক্তব্য এটা?
লজ্জায় লাল হয়ে অর্ক মায়ের সামনে মাথা নিচু করে বলে-- ধুর ওসব কেউ নেই আমার লাইফে। আমি সে সব নিয়ে ভাবি না।
ওসব কথা বাদ দাও একটা লালচে মেরুন রঙের সাথে গোল্ডেন পাড় দেওয়া কাঞ্জিভরম শাড়ি তার মায়ের গায়ে চাপিয়ে মলে থাকা আয়নার দিকে গীতা দেবীকে নিয়ে গিয়ে অর্ক বলল দেখো তো, তোমায় কত সুন্দর লাগছে এই শাড়ি টা পরে। তুমি কিন্তু শাড়ি টা ফিরিয়ে দিও না। আমি অনেক ভালবেসে তোমার জন্য এটা কিনেছি।
আয়নার দিকে তাকিয়ে গীতা দেবী অবাক হয়ে নিজেকে দেখছিলেন। সত্যিই তাকে শাড়ীটায় খুব সুন্দর মানিয়েছে। যেন অনেক অনেকগুলো বছর পর নিজেকে এতো নিখুত ভাবে দেখছে সে। মলের চোখ ধাঁধানো আলো রোশনিতে আয়নায় তাকে আরো বেশি উজ্জ্বল লাগছে। ফর্সা ছিপছিপে গঠনে গীতা দেবি কে এই গাঢ় রঙের শাড়িটা তার সৌন্দর্যতা আরো বাড়িয়ে তুলেছে ।অপলক দৃষ্টিতে আয়নার দিকে বেশ কিছুক্ষণ সে চেয়েই রইলো। এটা যে পাবলিক প্লেস যেন তার কোন ভ্রূক্ষেপ ই নেই। অর্কের হাতের স্পর্শে গীতা দেবীর টনক নড়ে।
---ওমন করে একভাবে আয়নার দিকে তাকিয়ে কি দেখছিলে মা? তুমি কতটা সুন্দরী তাই না?
--- এই ! মায়ের সাথে ফাজলামি তাইনা?
--- না, তুমি সত্যিই খুব সুন্দরী। ওই আয়নাটাও যে তাই জানান দিচ্ছে।
--- আচ্ছা হয়েছে.... কিন্তু এটা তো খুব দামী। এত টাকা খরচা করে আমাকে শাড়ি দেয়ার কোন মানে হয় !
---টিউশনি পরিয়ে নিজের রোজগার করে পছন্দ করে তোমায় শাড়ি দিলাম। জানো তো আমার মনের অদ্ভুত একটা শান্তি হচ্ছে। এই ফিলিংস টা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না।
প্রত্যেক বছর পুজোর শপিং করে ফেরার সময় তুমি আমায় খাওয়াও। এবছর আমি তোমায় খাওয়াব কিন্তু।
গীতা দেবী অর্কের হাতে হাত রেখে স্মিত হেসে চোখের ইশারায় সম্মতি জানালো।
--- সত্যিই এই রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানি টা খুব সুন্দর বানায় তাই না রে অর্ক খেতে খেতে গীতা দেবী প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন অর্কের দিকে।
----হমম, ভালোই। কিন্তু তুমি যে বিরিয়ানিটা বাড়িতে বানাও সেটার স্বাদ কিন্তু অতুলনীয়। যে কোনো ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট কে টেক্কা দিয়ে দেবে।
---মার খাবি এবার .... আবার ইয়ার্কি না !
--- সত্যি বলছি। তোমার দিব্যি দিয়ে বলছি।
খাওয়া শেষ হতেই অর্ক বললো মা তুমি এখানে ওয়েট করো, আমি বিলটা মিটিয়ে দিয়ে আসছি।
খাবার টেবিল ছেড়ে উঠতেই একজন মধ্য বয়স্কা মহিলার সাথে ধাক্কায় মহিলার হাতে থাকা ছোট ব্যাগটি নিচে পড়ে যায়।
ব্যাগটি মহিলাটির হাতে তুলে দিয়ে অর্ক বিনয়ীর সুরে বলে I'm sorry aunty।আপনার কোথাও লাগে নি তো?
অপ্রত্যাশিতভাবে মহিলাটি বললেন আচ্ছা তোমায় কোথায় যেন দেখেছি। খুব চেনা লাগছে তোমার ফেসটা ।
---আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে আন্টি। আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। মুখে সৌজন্যতার হাসি এনে প্রত্যুত্তরে অর্ক জানালো।
ভদ্রমহিলা কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে অর্ক কে রীতিমতো চমকে দিয়ে বললেন তোমার নাম অর্ক তো? অর্ক সেন?
আমি তোমার প্রভা আন্টি ।মনে পড়ছে তোমার?
এতক্ষণ গীতা দেবি চেয়ারে বসে এক মনে মোবাইল ঘাটছিলেন।
প্রভা নাম টি তার কর্ণ গহ্বরে প্রবেশ করা মাত্রই মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে চেয়ে দেখলেন । এক ঝলক দেখেই তিনি চিনতে পারলেন বিদিশার মা কে।
তাকে দেখা মাত্রই গীতা দেবীর সর্বাঙ্গ জুড়ে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেলো। মাথা ঝনঝন করতে শুরু করলো । তাকে এড়িয়ে অর্ককে নিয়ে সামনের দিকে দ্রুত হাঁটা দেবে সেই ক্ষমতাও যেন তিনি হারিয়েছেন। উৎকণ্ঠায় হাত, পা কাঁপতে থাকলো। আর দুটি মহিলার মাঝে অর্ক কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
--- নিজের হাতে সাজানো-গোছানো সংসারটাকে ছেড়ে নতুন সংসারে এসে একবারও মনে পড়েনি তোমার শিলিগুড়ির কথা? তোমার স্বামীর কথা?
--- কিগো তোমার হলো? একটা বিল মেটাতে তোমার কতক্ষন সময় লাগে শুনি?
পিছন দিক থেকে ধেয়ে আসা মধ্য বয়স্ক পুরুষ কণ্ঠস্বরে গীতা দেবী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন সুধাকর বাবু এগিয়ে আসছেন।
প্রভাদেবী ও সুধাকর বাবুকে একসঙ্গে দেখে গীতা দেবি ও খুব আশ্চর্য্য হয়ে যায়।
ওদিকে সুধাকর বাবুও আকস্মিকভাবে গীতা দেবী কে এইভাবে সশরীরে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণপর
নিজেকে সামলে নিয়ে গীতা দেবীর উদ্দেশ্যে বলেন ---
-- আপনার অন্তর্ধান এর কারণ টা কিছুটা আমি জানি।
প্রভা তোমার কাছে আমি এতগুলো বছর আসল ঘটনাটা চেপে গিয়েছিলাম। কারন সে কথা তোমার কানে গেলে তুমি লজ্জায় , অপমানে হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে।
---গীতা দেবী আপনার স্বামী কোনো অবৈধ কর্মে লিপ্ত ছিলেন না। তিনি একটি ভয়ানক চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন। ওনার দ্রুত ব্যবসার উন্নতি পাড়ার কিছু কিছু লোক এর সহ্য হয়নি । পাশাপাশি অশোক বাবুর দোকানটা কম দামে আত্মসাৎ করার জন্য সেই সময় প্রমোটার রাও তৎপর হয়ে ওঠে । তাকে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে যেনতেন প্রকারে ওই দোকান টা দখল করাই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য । কিন্তু তাদের কথামতো অশোক বাবু তিল তিল করে গড়ে ওঠা দোকান টা তাদের হাতে তুলে দিতে রাজি হননি। অশোক বাবু মাঝে মাঝেই দোকানের মাল আনতে এই কলকাতা শহরে আসতেন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে ছিল প্রোমোটাররা। কিছু ভাড়াটে গুন্ডা ভাড়া করে অশোক বাবু কে তারা কিডন্যাপ করে। আর আমার স্ত্রী প্রভা যেহেতু সেইসময় আপনাদের বাড়িতে যাতায়াত করত তাই ওর নামের সাথে আপনার স্বামীর নাম জড়িয়ে কুৎসা রটায়।
ছি ছি ছি ! ! ! এ কথা শোনাও যে পাপ। তুমি আগে কেন বলো নি একথা সুধাকর?
--- স্বামী হয়ে নিজের স্ত্রীর নামে রটানো এ একথা গুলো আমি কি করে তোমায় বলতাম প্রভা ?
--- সেইমতো অশোক বাবুকে তারা কিছুদিন নিজেদের হেফাজতে রেখে আমার নাম করে আপনাদের বাড়ি ভাঙচুর করে ,। আর এতে মত দিয়েছিল পাড়ার হেবলো, কেদার নামে অমানুষদের দলগুলো। তাদের জন্য আপনাদের সুখের সংসার টা নষ্ট হয়ে গেল।
কিন্তু মিসেস গীতা দেবী তাদের কথায় নিজের স্বামীকে অবিশ্বাস করলেন? একবারো থানাতেও গেলেন না ? কিংবা আমাদের বাড়িতে এসেও এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করতেও আসলেন না?অশোক বাবুর প্রতি আপনার ভালোবাসা, বিশ্বাস এতটাই ঠুনকো যে তাকে বাইরের লোকের কথায় অবিশ্বাস করে ঘর ছারলেন? এক বারও মনে হলো না নিখোঁজ স্বামীর খোঁজ নেওয়ার কথা।
-গীতা দেবী সত্যি ই নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এত বছর ধরে যে মানুষ টার প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ পুষে রেখেছিলেন সেইসব ভুল ভ্রান্তি এক লহমায় ভেঙে গেলো।
---অশোক বাবুকেও জানোয়ারের দল গুলো বুঝিয়ে ছিলো আপনিও না কি নতুন সঙ্গীকে নিয়ে বাড়ি বেচে অন্য কোথাও সংসার পেতেছেন। কিন্তু তিনি সেটা বিশ্বাস করেননি। আপনি শিলিগুড়ি ত্যাগ করার পরেই তারা অশোক বাবুকে ছেড়ে দেয়। অপরাধীরা খুব ভালো করেই জানত অশোক বাবুর দুনিয়ায় আপনি আর অর্ক ব্যতীত আর কেউ নেই । তাই তারা এভাবেই ওনাকে মানসিক দিক থেকে হত্যা করেছিল।
সুধাকর বাবুর কথার মাঝে প্রভা দেবী বলে উঠলেন --- এত কিছু ভেতরের খবর আমি কিছুই জানতাম না। এত বছর ধরে আমি গীতাকেই খারাপ ভেবে এসেছি। চরিত্রহীনা ভেবে এসেছি। আসলে ও চলে যাওয়ার পর তেমন একটা বাইরে কোন প্রতিবেশীর সাথে আমি মিশতাম না। আমার বাড়ির কাজের মেয়ে মিনুর থেকে শুনেছিলাম গীতা নাকি অন্য পুরুষের সাথে সংসার করার জন্য বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছে।
ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অশোকবাবু নির্দ্বিধায় কম টাকার বিনিময়ে তার দোকানের অংশ প্রোমোটারদের হাতে তুলে দেয়। পিতৃমাতৃহীন অশোকবাবু জীবনে বাঁচার রসদ হিসেবে যাকে জীবন সঙ্গিনী রূপে গ্রহণ করেছিলেন তার চলে যাওয়া কে মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। একেবারে নিঃস্ব হয়ে আমার শরণাপন্ন হয়েছিলেন । শুনিয়েছিলেন সেই মর্মান্তিক কাহিনী। পরবর্তীকালে হেবলো, কেদার কে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল মানহানির অপরাধে । ভাড়াটিয়া গুন্ডাদের কোন হাদিসই পুলিশ পায় নি। নিজের সর্বস্ব হারিয়ে প্রোমোটারদের বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ তিনি করেননি। তবে আজও অপেক্ষা করে আছেন অর্ক ও আপনার জন্য।
সুধাকার বাবুর সামনে করজোড়ে মাথা নিচু করে গীতা দেবী কাঁদতে কাঁদতে বলেন আমি এত বছর ধরে শুধু ভুলই করে গেছি। অন্যায় করে গেছি নিরপরাধ মানুষটার উপর। নিজের দোষেই এতগুলো বছরের সুখ, শান্তি আমি নিজে খুইয়েছি। জানি আমি ক্ষমারও অযোগ্য। আর অর্ক কেও তার বাবার স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছি।
কিন্তু সুধাকর বাবু দোহাই আপনার.... আপনি আমার স্বামীর যদি কোন খবর জানেন আমায় বলুন। আমি আমার এই কৃতকর্মের জন্য ওনার পা ধরে ক্ষমা চাইবো। নাহলে অনুগ্রহ করে ওনাকে খুঁজে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন ।আমায় সাহায্য করুন।
--- আপনি শান্ত হন গীতা দেবী। অশোক বাবু ভালো আছেন ।সুস্থ আছেন ।এবং আমাদের কাছেই আছেন। ওই দিনের পর থেকে সহায়-সম্বলহীন অশোক বাবুকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারি নি। প্রথম দিকে আমার কোম্পানিতেই উনি কাজ করতেন। এখন আমার ব্যবসার পরিধি আগের চেয়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আমার শিলিগুড়ির একটা কারখানার সমস্ত ভার ওনার উপর দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি। ওনাকে আমি কর্মচারী দৃষ্টিতে দেখি না। নিজের কঠোর পরিশ্রম আর সততার দ্বারা উনি আমার মন জয় করে নিয়েছেন । উনি এখন আমাদের সাথেই থাকেন। আমাদের পরিবারেরই একজন। আমাদের একমাত্র কন্যা বিদিশাকে অশোক বাবু কন্যা সম ভালোবাসেন। আজ এখানেও অশোকবাবু এসেছেন । ওনার সাথে বিদিশা পাশের শপিং মলে শপিং করছে। বিদিশা আবার তার অশোক আংকেল কে ছাড়া কিছু বোঝেনা।
এত বছর পর স্বামীকে দেখার জন্য গীতা দেবি ছটফট করতে থাকে। অর্ক কে বলে-- তুই তো শুনলি সব ঘটনা। তোর বাবা অপরাধী নয় রে। কোন পাপ তিনি করেনি। যা শপিংমল থেকে তোর বাবা আর তোর ভবিষ্যৎ জীবন সঙ্গিনী কে চিনে নিয়ে আয় আমার কাছে।
সমাপ্ত -- সম্পূর্ণ গল্পটি পড়তে কেমন লাগলো? অবশ্যই বন্ধুরা কমেন্ট করে জানাবেন। এবং আমার পরবর্তী গল্প গুলো ও পড়ার অনুরোধ জানালাম।
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ