ষড়যন্ত্রের শিকার দ্বিতীয় পর্ব
কথাগুলো বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানোয়ারগুলো নিজেদের মধ্যে পৈশাচিক ভঙ্গিমায় হাসতে হাসতে পায়ে ঘসঘস শব্দ করতে করতে দ্রুত মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। তারা চলে যাওয়ার পরেই গীতা দেবী হাত থেকে বঁটি টা সশব্দে মেঝে তে ফেলে অসহায় ভাবে কাঁদতে থাকলো।
বিস্ময় মিশ্রিত দু চোখ মেলে ভয়ে ভয়ে অর্ক তার মা কে প্রশ্ন করলো " ওরা কি বলে গেলো মা?
জবাবে গীতা দেবী কিছুই বললো না। শুধু মেঝে থেকে মাথা টা তুলে কান্নায় লাল হয়ে যাওয়া চোখ মেলে অর্কের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
বাবা কোথায় আছে মা? তুমি যে কাল রাতে বলেছিলে বাবা দোকানের জন্য কাপড় আনতে কলকাতায় গেছে । আসতে দেরি হবে। তবে এখনো এলো না কেন?
এবার অর্কের কথায় রূঢ় মূর্তি ধারণ করে চিৎকার দিয়ে অর্কের মুখের সামনে তর্জনি উঁচিয়ে বললেন" তোর বাবার নাম আর জীবনেও আমার সামনে করবিনা। এই আমি আমার মাথার দিব্যি দিয়ে তোকে বললাম। লোকটা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে । আর বিদিশার সাথেও তুই আর কোনদিন কথা বলবি না। এ কথা যেন তোর মনে থাকে।
আঁচলে চোখের জল মুছে মেঝে থেকে উঠে অর্কর হাত দুটো ধরে আবার গীতা দেবী একটু শান্ত হয়ে বললেন কয়েকদিনের মধ্যেই এই পাড়া ছেড়ে আমরা অন্যত্র চলে যাব। সেখানে তোকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো।
অবাক হয়ে আবেগমেশানো কণ্ঠে অর্ক তার মাকে বলল" কিন্তু মা বিদিশার তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
কথাটা বলা মাত্রই সেদিন মায়ের কাছে ভীষণ মার খেয়েছিল সে। অপমান, লাঞ্ছনার সমস্ত জ্বালা উগরে গিতাদেবী এলোপাথাড়ি মেরেছিলো তার প্রানের অধিক প্রিয় সন্তানকে। মারের চোটে রাতের দিকে অর্কর জ্বর এসে গিয়েছিল।
পরক্ষণেই নিজের সেই অপকর্মের জন্য আফসোসে নিজেকেই সে মনে মনে নানা অপবাদ দিতে থাকে। আতঙ্কের সাথে সারারাত জেগে জল পট্টি দিয়ে ভোর রাতের দিকে পারদ টা অনেক টা নেমে আসে অর্কর। শরীরের উষ্ণতা স্বাভাবিক হয়।
অর্ক চোখ মেলে তার মায়ের হাত টা স্পর্শ করতেই সে ঝেরেমেরে উঠে বসে। জলপট্টি দিতে দিতে কখন সে ঘুমিয়ে পরেছিল বুঝতে পারেনি।
মা আমি আর কক্ষনো বিদিশার নাম মুখেও আনবো না। এই তোমায় ছুঁয়ে প্রমিস করলাম।
অর্ককে জড়িয়ে ধরে তার সারা শরীরে চুমু দিতে দিতে গীতা দেবী বললো" খুব লেগেছে তাই না সোনা! আর কখনো মারবো না। কোনো ক্রমে গলা থেকে উগরে আসা কান্না কে দমিয়ে সে আবার বলল তুই ছাড়া যে আমার আর এই দুনিয়ায় কেউ নেই। যাকে ভরসা করে একদিন নিজের মেয়েবেলার ঘর ছেড়েছিলাম সেই আজ আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। আজ বিদিশার বাবা লোকজন নিয়ে এসে তোর বাবা কে না পেয়ে আমাদের ঘরের সব আসবাবপত্র ভেঙে চুরে দিয়ে গেছে। তুই এই কটা দিন আর স্কুলে যাস না সোনা।
না জানি একা রাস্তায় পেয়ে ওরা তোকেও ...
বলতে বলতে গিতাদেবী নিজের মুখেই হাত দুটো চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
তারপর আনমনেই অর্কর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন
আমরা এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব। সেখানে তোর জীবনে আর কোন পাপের ছায়া থাকবে না।
তারপর ভালো মানুষের অন্তরালে থাকা সেই জানুয়াররূপী মানুষগুলোর পুনরায় কু প্রস্তাব নিয়ে আসার কোনো সুযোগই দেয়নি গীতা দেবী। দিন পনেরোর মধ্যেই প্রায় জলের দামে বাড়ি খানা বেচে দিয়ে অর্ক কে নিয়ে তিনি অন্যত্র চলে যান।
এরপর বিশাল বড় কলকাতা শহরের মা ছেলে দু কামরা ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু হয় নতুন সংসার। বাড়ি বিক্রি করার টাকা ব্যাঙ্কে রেখে এবং প্রথমদিকে অল্প কিছু টাকায় একটি সেলাই মেশিন কিনে বহুকষ্টে সংসার চালাতে হয় তাদের। গীতা দেবীর জীবনের সংগ্রামটা ঠিক এখান থেকেই শুরু হয়েছিল । ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এর বদলে সরকারী বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য হন অর্ককে। কোনো গৃহশিক্ষক রাখার ক্ষমতা তখন ছিল না। সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে সামলে তিনিই অর্ককে পড়াতেন। রাত জেগে পরিশ্রম করে সেলাই করে বহুকষ্টে অর্থ উপার্জন করতেন। তাতে মাসিক আয় যতটুকু হতো তাতে টেনেটুনে সংসার চালানো বেশ কষ্টকর ছিল। অচেনা জায়গায় তার ওপর তিনি নতুন ভাড়াটিয়া সেইসব কারণে তার কাছে অনেকেই জামা কাপড় সেলাই করতে দিতে চাইতেন না। তাছাড়া গীতা দেবীর পরিচিতির অভাবও তার আয়ের এর ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল। কোন কোন মাসে বাড়ি বিক্রির জমানো টাকা ব্যাংক থেকে তুলে এনে বাড়িভাড়া মেটাতে হতো তাকে। ছোট্ট অর্ক মায়ের কষ্ট অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারত। তাই তার বয়সী বাচ্চারা যখন স্কুল থেকে ফেরার পথে খেলনার দোকান, ফাস্টফুডের দোকান দেখলে বায়না করত সে তখন চুপচাপ মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যেত মায়ের সাথে।
শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা আসার পরেও বহুদিন অর্ক তার বাবার জন্য নীরবে চোখের জল ফেলেছে। তার মাকে সে বুঝতে দেয়নি তার কষ্টের কথা। বিদিশাকেও অনেকবার স্বপ্নে দেখেছে। কিন্তু ঘুর্নাক্ষরেও সেসব স্বপ্নের খবর মাকে জানায়নি। সে যে তার গর্ভধারিনী মা কে কথা দিয়েছে এই দুটি মানুষের নাম সে কখনোই তার মায়ের সামনে মুখে নেবে না।
শিলিগুড়িতে ওই বাড়িতে তার বাবার ফিরে না আসার কারণ তখনও ছোট্ট অর্কর এর কাছে ছিল অস্পষ্ট । অতটুকু বয়সে পাড়া-প্রতিবেশীদের বলা কথাগুলোর মানে সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার বাবা যে খুব ভয়ানক কোন দোষ করেছে তাই কখনোই তার মা তার বাবার সাথে থাকতে চায় না এটুকু সে বুঝতে পেরেছিল। তাইতো মনের গভীরে তার বাবাকে নিয়ে কৌতুহল জাগলেও সে সব কথা তার মাকে কোনদিনও প্রকাশ করেনি।
এই ভাবেই কষ্ট কে সাথী করেই মা , ছেলের কয়েকটা বছর কেটে গেল। বছর পাঁচেক পর একটি খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার খালি পদে ফরম ফিলাপ করেছিলেন গিতাদেবী। ভাগ্যক্রমে সে চাকরি টা পেয়েও যায় । ফলে শিক্ষকতা ও সেলাই দুটো কাজই গীতা দেবি একসঙ্গে করতে থাকেন। অর্কও দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে সায়েন্স নিয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ইদানিং অর্ক টিউশনি পড়াতে শুরু করে। গীতা দেবির তুমুল আপত্তি সত্ত্বেও সে এই কাজ থেকে বিরত থাকে নি । মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার কষ্টটা লাঘব করাই এখন তার মূল কাজ। এতদিনে তার বাবার নামটা তার স্মৃতিতে ফিকে হয়ে গেছে। বিদিশার কথাও এখন তার মনে পরেনা।
কিন্তু ঘুম না আসা গভীর রাতে আজও গীতা দেবীর মনে পরে স্বামী অশোক সেনের কথা। সে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না এগারো বছর আগে ঘটে যাওয়া অভিশপ্ত ঘটনাটির সত্যতা কতটা গভীর। এখনো কিছু কিছু ঘটনা তার কাছে ধুয়াশার মতোই অপরিষ্কার । বিদিশার মা প্রভা দেবী ওদের বাড়িতে আসলেও কোন দিন অর্কের বাবার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ তিনি তখন ব্যবসার কাজে দোকানেই থাকতেন। এমনকি তিনি প্রভাদেবীর মুখেও কোনদিন তার স্বামীর প্রসঙ্গ নিয়ে কোন আলোচনাই শোনেন নি। বরঞ্চ প্রভাবশালী বিত্ত শালী পরিবারের বউ হওয়া সত্বেও প্রভাদেবী খুব সহজভাবেই তাদের সাথে মিশতেন। তার চরিত্রের মধ্যে কোন অহংকার বা দাম্ভিকতা ছিল না। কিন্তু তিনি যে মানসিক দিক থেকে অবসাদে ভুগতেন তার কথাবার্তার ধরণে স্পষ্ট তার ইঙ্গিত পাওয়া যেত।
ইদানীং মাঝে মাঝে গীতা দেবীর মনে হয় এগারো বছর আগে তিনি কি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন! আচমকা অপ্রত্যাশিত অপমানের ঝড় আছড়ে পড়ায় দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ভালো-মন্দ বিচার না করেই চোরের মত এতদূর চলে আসা কি উচিত হয়েছিল! থানা-পুলিশ তো চাইলে গীতা দেবীও করতে পারত। দোষ যদি স্বামী করেও থাকে বাড়ি ভাঙচুর করে একজন মহিলাকে কটুক্তি করার কোন অধিকার তাদের ছিল না। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আইন তার সাথেই থাকতো।
চলবে....( গল্পটি পড়তে কেমন লাগছে বন্ধুদের কমেন্ট করে জানানোর অনুরোধ রইলো।)
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ