অনিমেষ বাবুর একমাত্র ছেলে অরিন। বয়স কুড়ি পেরিয়েছে। চেহারায় আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। উজ্জল শ্যামবর্ণ, উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট এর কাছাকাছি। বেশ হ্যান্ডসাম । পড়াশোনায় ছোট থেকেই একদম মন ছিলনা তার। তাই যাহোক করে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পাড় করে আর কলেজে ভর্তি হয়নি সে। ইঞ্জিনিয়ারিং , কিংবা ডাক্তারি লাইন দূর হস্ত। পাস কোর্স নিয়ে কলেজে পড়ার ইচ্ছেও তার নেই। কিন্তু অনিমেষ বাবুর খুব ইচ্ছে ছিল ছেলেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পড় ওকালতি পড়াবেন। তার সেই আশায় জল ঢেলে অরিন এখন পাড়ার বখাটে ছেলেদের মধ্য মনি। তার ভবিষ্যত জীবন নিয়ে অরিনের মা প্রভাদেবী খুবই চিন্তিত। অনিমেষ বাবুর পাড়ার মোড়ে একটি চালু মুদিখানা দোকান আছে। তাই আর্থিক দিক থেকে পরিবারটি মোটামুটি স্বচ্ছল। কিন্তু পড়াশোনায় অমনোযোগী হলেও অরিন মানুষ হিসাবে খুবই ভদ্র। তার মধ্যে একটি কোমল, নরম মন আছে। মানুষের দায়, বিপদে সে ঝাপিয়ে পড়ে। অনিমেষ বাবুর কাছে ব্যাপারটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো । কোনো দুঃস্থ মানুষকে টাকা দিয়ে অরিন সাহায্য করলে অনিমেষ বাবু অরিনের উদ্দেশ্যে এই প্রবাদ বাক্যটি প্রায়শই প্রয়োগ করে থাকেন। তাতে প্রভা দেবী মনোক্ষুন্ন হয়ে বলেন -- আহা! এসব কাজে ছেলেকে বাধা দিও না। ছেলেটা মানুষের দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াতে বরাবরই ভালোবাসে। প্রভাদেবী কে ভৎসনার সাথে অনিমেষ বাবু বলেন -- তুমি চুপ করো প্রভা। এই তোমার আশকারাতেই ছেলেটা উচ্ছনে গেছে।
আজকাল কত রাত করে বাড়ি ফেরে অরিন সেটা নজরে রেখেছো? নাকি সবকিছু দেখে , বুঝেও ছেলেকে আড়াল করার চেষ্টা করছ? উঠতি বয়সী ছেলে। যদি কোন অপকর্ম করে বসে থাকে পারবে তো সমাজে মুখ দেখাতে? অপকর্মের কথাটা শুনে প্রভাদেবীর বুকটা একটু কেঁপে উঠলো। একটা অজানা ভয় তাকে গ্রাস করল। ছেলের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস থাকলেও ইদানিং অরিনের এই রাত করে বাড়ি ফেরাটা তারও সুবিধার মনে হচ্ছিল না।
প্রভাদেবীর মনে পড়ল গতকালই অরিন অনেক রাত করে ঘরে ফিরেছে। ওর বাবা তখন খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। অরিনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রভা দেবী খাবার টেবিলেই বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গভীর রাতে সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে প্রভাদেবী ধরমড় করে উঠে দরজা খোলেন। অরিন কে দেখে সে তো রীতিমতো চমকে যায়। গায়ে ধুলোয় ভর্তি । পরনের জামাটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। প্যান্ট এ কাদার ছিটে। হাতে পায়ে আঁচড়ানোর চিহ্ন। ঘামে ধুলোবালি লেগে গায়ে লেপটে গেছে। চুলগুলো উসকো খুসকো।
--- অরিন তোর কি অবস্থা ? কোথায় ছিলিস এতক্ষণ?
--- বাড়িতে ঢুকতে দেবে? নাকি এখানেই দাঁড় করিয়ে সব কথা জিজ্ঞাসা করবে?
ঘরে ঢুকেও গতকাল রাতে অরিন সে ভাবে তার মায়ের সাথে কেন কথা বলে নি। স্নান করে জামা-প্যান্ট ধুয়ে খেতে বসে গিয়েছিল । শুধু প্রভা দেবী কে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো--- মা তুমি একদম টেনশন ফ্রি থাকো। তুমি এটুকু আমার উপর বিশ্বাস রাখো। তোমার ছেলে কোনদিন ও কোনো অন্যায় কাজ করবেনা।
অরিনের এইটুকু কথাতেই প্রভাদেবীর মনটা শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ছেলের কপালে একটা চুমু দিয়ে শুতে চলে গিয়েছিলেন।
পরদিন সকাল হতেই অরিনের বন্ধুবান্ধবরা বাড়ি এসে তাকে ডাকতেই কোনমতে চা টুকু খেয়ে সে আবার বেরিয়ে পড়ে।
অনিমেষ বাবু বাধা দেওয়া সত্বেও তার আদেশ অমান্য করেই হন্তদন্ত হয়ে বন্ধু দের ডাকে সে বেড়িয়ে পড়ে।
খানিকটা বিরক্তি ও মনের মধ্যে থাকা একরাশ রাগ নিয়ে অনিমেষ বাবুও রওনা দেন দোকানের উদ্দেশ্যে।
পাড়ার মোড়েই তার মুদিখানা দোকান। এখানে ওখানে জটলা বেঁধে পাড়ার লোকেদের কিছু গুঞ্জন, অনিমেষ বাবুর দৃষ্টি এড়াল না। সারাদিন দোকান খুলে রাখলেও বিক্রি, পাটটায় আজ আর তেমন মন বসাতে পারলেন না। একদিকে ছেলের বোহেমিয়ান জীবনযাপন, তার ওপর পাড়ার লোকেদের গুজগুজ , ফিসফাস উদ্রেক জনক চাওনি যেন তার মনকে আরো অশান্ত করে তুলছিল।
তাই আজ দুপুর বেলা একটু তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে অনিমেষ বাবু খেতে যাওয়ার জন্য বাড়ি ফিরছিলেন।
"ওইটুকু ছেলের এত সাহস ভাবা যায়! " রাস্তায় এটুকু কথাই অনিমেষ বাবুর কানে এলো। তার মনে হলো কথাগুলো যেন অরিনের এর উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে।
কি এমন করেছে অরিন ভালো কিছু নাকি কারো কিছু সর্বনাশ!
-- না না ! আমার অরিন আর যাই করুক মানুষের কোন ক্ষতি সে চায় না। অনিমেষ বাবু মাথা থেকে সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা ধারা গুলোকে সরিয়ে রেখে বাড়ি ঢুকলেন।
--- কিগো আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে ? শরীর ভালো তো ?
প্রভা দেবীর কথায় মুখে কোন বাক্য ব্যয় না করে অনিমেষ বাবু সোজা ঘরে ঢুকে গেলেন।
--আশ্চর্য তো! মুখে কিছু না বললে বুঝবো কি করে !
প্রভাদেবীর কথায় এবার ঘর থেকেই অনিমেষ বাবু উচ্চস্বরে চিৎকার করে বললেন
---তোমার গুণধর ছেলের চিন্তায় আমার রাতদিন বুক ধরফর করে জানাতো? কিছু ভালো লাগেনা।
-- মা খেতে দাও খুব খিদে পেয়েছে। সবসময় দুজনে এত কথা কাটাকাটি কেন করো বলতো? একটু শান্তিতে থাকতে পারো না?
বাড়ি ঢুকেই মা-বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে অরিন বলল।
--- ওই যে চলে এলেন নবাব পুত্তুর!
দান, ধ্যান, সেবা করে বাড়ির অন্নধ্বংস করতে । অনিমেষ বাবুর দিকে চোখ ঠেলে প্রভাদেবী ক্ষীণ সরে বললেন
--- আহা ! ছেলেটা দুপুরবেলায় ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরল । ও সব অলুক্ষনে কথা তোমার না বললেই নয়?
অরিন তার বাবার কথাগুলো শুনতে পেয়েও কিছু বলল না। এসব রোজকার ছোটখাটো অপমান তার সয়ে গেছে । হাত মুখ ধুয়ে এসে চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো।
অরিন ঘরে ঢুকে যাওয়ার পর অনিমেষ বাবু আবার প্রভা দেবীকে বললেন
--- লাই দিয়ে দিয়ে ছেলেটা কে তুমিই তো মাথায় তুলেছ। আচ্ছা প্রভা ও পড়াশোনাটা ছেড়ে দিল। আমরা তো আর জোর করে ওকে ধরে বেঁধে কলেজে ভর্তি করতে পারবো না ।ওর তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। আমার সাথে মুদিখানা দোকানে গিয়েও তো সকালের দিকটা বসতে পারে ।আমার ব্যবসাটাই না হয় মন দিয়ে করুক। সেটা ও করবে না। কি চায় ও কি জানি! এবার আমারও তো আস্তে আস্তে বয়স হচ্ছে। এখন যদি নিজের হাতে ব্যবসাটা তাকে বুঝিয়ে দিতে পারতাম তাহলে নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারতাম ।দেখে যেতে পারতাম যে ছেলেটার একটা গতি হয়েছে।
হঠাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে অনিমেষ বাবু থমকে গেলেন। কৌতুহলী মনে দরজাটা খুলতেই
---এটাই অরিন বসু মল্লিকের বাড়ি তো? বাড়িতে হঠাৎ থানা থেকে পুলিশ আসাতে অনিমেষ বাবু ঘাবড়ে যান। আমতা আমতা করে বলেন
---আজ্ঞে, এটাই । আমি ওর বাবা অনিমেষ বসুমল্লিক।
সদর দরজায় দুজন পুলিশের সাথে কথা বলতে দেখে প্রভাদেবীর বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
--- আমরা মিস্টার অরিন বসুমল্লিক সাথে একটু কথা বলতে চাই। ওকে এক্ষুনি একবার থানায় যেতে হবে।
---কেন ? কি করেছে ও? কাঁদো কাঁদো গলায় ঘর থেকে একপ্রকার ছুটে এসে প্রভা দেবী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন। তাকে আশ্বস্ত করে একজন দারোগা বাবু বললেন
--- ভয় পাওয়ার কিছু নেই মাসিমা... গতকাল একজন নারী পাচারকারী দল কে আমরা মিস্টার অরিনের সহায়তায় ধরতে পেরেছি। কলকাতা ব্যাপী এদের একটা দল বেশ কিছুদিন ধরে এইসব জঘন্য অপরাধমূলক কাজ চালাচ্ছিল। আর এই এলাকাতে ওদের উৎপাতের খবর পেয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ থেকে তাদের অবিলম্বে ধরার জন্য খুব চাপ ও আসছিল আমাদের। গতকালই তাদের দলের মোট চারজন গ্যাং কে আমরা হাতেনাতে পাকড়াও করতে পেরেছি অরিনের সাহায্যে।
ওদের মুখে এসব কথা শুনে অনিমেষ অবাক হয়ে গেলেন ।দারোগাবাবু বিনয়ের সাথে বললেন আপনার ছেলে কিন্তু সত্যিই একটি রত্ন অনিমেষ বাবু। ওর জন্যই অনেক মেয়ে বেঁচে গেল। বেঁচে গেল তাদের সম্মান তাদের কুমারীত্ব।
বড়বাবু ওকে ডেকেছেন কারণ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ তাকে বিশেষ সম্মান জানাতে চায়। ও ভবিষ্যতে একজন সৎ পুলিশ কর্মী হিসেবে দেখতে চান। এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য সমস্ত সুবিধা তাকে দেওয়া হবে। ছেলের গর্বে বুক ভরে গেল অনিমেষ বাবু ও প্রভা দেবীর। দু জনের চোখ দিয়েই নোনা জলের ধারা অজান্তেই মাটিতে পড়তে থাকলো। এ জল যে লজ্জার নয়, অনন্দাশ্রুর।
সমাপ্ত
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ