জীবনসঙ্গিনী (অন্তিম পর্ব)

 

female partner of life last part

আগের পর্ব পড়ুন

জীবনসঙ্গিনী  (অন্তিম পর্ব)


---এই খবরদার  বলছি বিভা  মিথ্যা কথা বলবে না।  আমি তোমার গায়ে হাত তুলেছি ঠিকই  কিন্তু ছেলে মেয়েদের উপর কোনদিন অত্যাচার করিনি।

---তা করো নি। কিন্তু আমার সৎ ভাবে উপার্জন  করা টাকা গুলো মদ খাওয়া, আর জুয়ার পেছনে উড়িয়ে দিতে । আর ছেলেমেয়েগুলো না খেতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ত। সে খেয়াল রেখেছিলে কখনো?   এটা কি  একপ্রকার অত্যাচার নয়? 

 বাবা কোন উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পরলো। সেদিন আড়াল থেকে সব কথা শুনে মাকে আর ঘেন্না করি নি।  বেশ্যা বৃত্তির সাথে জড়িয়ে পরলেও মায়ের থেকে আর সরে থাকতে পারিনি।  ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। মাও আমায় আঁকড়ে ধরে খুব কেঁদেছিল সেদিন।

 বেশ্যা দের  দালাল মানিককে মা বিয়ে করেছিল আমাদের একটু সুখে রাখার জন্যই।

 এরপর থেকে মা মাঝে মাঝেই আসতো। বাবাকে টাকা দিয়ে যেত।রাতে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়ে ভোর ভোর বেরিয়ে যেতো।

 আমি পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলাম না।  এখানে তো আর ভাগ্যের দোষ দেয়া যায় না। এটা ধরে নে আমারই দোষ । তাও টেনে টুনে কোনোমতে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছিলাম।   আমার বোন দীপা কিন্তু পড়াশোনায় বরাবরই ভাল ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনো কোনো চাকরি পেল না। মেয়ে টার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। এত গুলো বছর সংসার এর সমস্ত কাজ একা হাতে সামলে পড়াশোনা করেছে। একটা চাকরি না পাওয়া তে বেচারী মনে মনে খুব কষ্ট পায়।  এখন টেকনিক্যাল লাইনের যুগ। ওই   লাইনে পড়াশোনা করলে যাহোক বেসরকারি চাকরি হয়তো জুটে যেত ওর কপালে। কিন্তু ও তো এম.এ পাশ। 

 সরকারী চাকরির আশায় শুধু পরীক্ষাই দিয়ে যাচ্ছে।  কোনো কল আসছে না।

--- তোমার মা এখনো তাহলে তোমাদের সংসার চালিয়ে যায়?

--- না, তার এখন বয়স হয়েছে। এখানে আর তেমন আসে না। 

-- তাহলে তোমাদের সংসার এখন কিভাবে  চলে? শুনেছি  তুমি তো একটা  লেদের কারখানায় কাজ করো তাই না? 

--- হ্যাঁ, করি কিন্তু যা পাই তা তো অসুস্থ বাবার  ওষুধের  পেছনেই চলে যায়।  মানুষটা  সারাটা  জীবন নিজেও জ্বললো আর  আমাদেরও  জ্বালিয়ে মারলো।

-- তোর তো কোন ব্যাপারই না ...কলেজ পাস করেই  বাবার কোম্পানিতে বসে যাবি।

-- হ্যাঁ, তা তো দেখতেই হবে ব্যবসাটা। 

--- চল অনেক রাত হল । এবার বাড়ি ফেরা যাক। বোন ফোন করছিল বাড়ি ফিরি নি বলে। বেচারা আমার জন্য না খেয়েই হয়তো বসে আছে। 

--; কাল আমার সাথে সকাল বেলা দশটার সময় একবার দেখা করতে পারবে?

---হ্যাঁ, কাল তো সোমবার। কালকে সারাদিনি ফ্রি আছি। আমাদের কারখানা কাল বন্ধ থাকে।  কিন্তু ব্যাপারটা কি বলতো? 

---সৌরভ দার  হাতে একটা ভরসার হাত এগিয়ে দিয়ে দীপ্ত বলল সারপ্রাইজ।

 পরদিন যথারীতি দীপ্তর কথামতো তাদের চৌমাথা মোড়ে এসে দাড়ালো । সৌরভ  একটু আগে আসায় তাকে একটু অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

দীপ্তর লাল চারচাকা গাড়িটাকে দূর থেকে চিনতে পেরেই সৌরভ জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা রাস্তায় ফেলে জুতো দিয়ে রোগড়ে উৎসুক হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইলো।

---সৌরভ দা উঠে এসো গাড়িতে।

---আরে, না না... কোথায় যেতে হবে বল আমি পৌঁছে যাচ্ছি।

গাড়িতে শুধুমাত্র দীপ্ত থাকলে সৌরভ হয়তো এতটা ইতস্তত করত না। কিন্তু গাড়ির সামনের সীটে বসে থাকা প্রভাবশালী , নামকরা ব্যবসায়ী মিস্টার কুনাল অধিকারীকে দেখে তার বুকটা ঢিপঢিপ করছিল। একই পাড়াতে একটু তফাতে থাকলেও কোনোদিন কুনাল অধিকারীর সামনা সামনি হওয়ার সৌভাগ্য হয় নি তার। আর ওতো বড়ো একজন ব্যস্ত মানুষের পক্ষে সৌরভকে চেনাও কুনাল বাবুর পক্ষে অসম্ভব। 

যাইহোক দীপ্তর বাড়াবাড়িতে সৌরভ সেই গাড়িতে উঠতে বাধ্য হলো। গাড়ির পিছনের সীটে দীপ্তর প্রায় গা ঘেঁষেই সৌরভ বসলো। তাকে কি জন্য ডেকেছে দীপ্ত সেই সারপ্রাইজ টার হদিস এখন সৌরভ একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছে। মনে মনে দীপ্তকে সে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালো। দীপ্তর স্বভাব সম্পর্কে ভুরি ভুরি মন ভালো করা কথা সে ক্লাবের অন্যান্য ছেলেদের মুখে আগেও শুনেছে।  তার বিশ্বাস হতো না। কিন্তু দীপ্তর এত নরম মনের কাছাকাছি সে আজ প্রবেশ করেছে। তার ভরসার হাত টা যে এতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটা সে আগে কল্পনাও করতে পারেনি।

---তুমি তো সঞ্জয় বসুর ছেলে?

গাড়ির সামনের সীট থেকে ভেসে আসা কুনাল অধিকারীর প্রশ্নে সৌরভ কিছুটা ভয় ও আড়ষ্ট গলায় বলে 

---আজ্ঞে, হ্যাঁ আঙ্কেল... মানে সরি... স্যার।

---সঙ্গে সঙ্গে ওপ্রান্ত থেকে একরাশ হালকা হাসির সাথে কুনাল বাবু বললেন তুমি আমায় আঙ্কেল ই বলবে।

আমার কোম্পানি তে তোমায়  কাজে নিযুক্ত করতে চাই। তুমি সততা ও দায়িত্বের সাথে তা করতে পারলে আগামী ছয়মাসের মধ্যে তোমার স্যালারী আশানুরূপ বাড়িয়ে দেবো। তুমি এতে রাজি?

---সৌরভ যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে আমতা আমতা করে বললো কিন্তু আমার যে কুয়ালিফিলেশন খুব  কম আঙ্কেল। 

--ডোন্ট ওরি... দীপ্ত আমায় সব জানিয়েছে। আমি তোমার যোগ্যতা অনুসারেই কাজ দিয়েছি। 

তোমার বোন দিপাকেও আমাদের কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করতে চাই...সে রাজি থাকলে জানিও।

এ যে মেঘ না চাইতেই জল।

সৌরভ উৎফুল্লতার সাথে বললো-- ও নিশ্চই করবে। এ যে ওর পরম প্রাপ্তি।


---তোমায় আরো একটা কথা বলা হয় নি সৌরভ...

lতোমার সাথে দেখা করার আগেই আমরা একবার তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।আমি স্পষ্ট কথার মানুষ। তোমার বোন কে দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ওকে আমার পুত্রবধূ রূপে আমার ঘরে আনতে চাই। আমি তোমাদের জীবনের ভালো মন্দ সব কাহিনী ই কাল দীপ্তর মুখে শুনেছি। তোমায় একটা জব দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তোমার বাড়িতে গিয়ে ওমন শান্ত, লক্ষহীমন্ত মেয়েকে দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ওকে দেখে আমার মনে হলো একমাত্র ওই পারবে আমার গাইয়ে ছেলে কে আয়ত্তে আনতে, সংসারী করতে।  আমার ছেলের সাথে আমার সাথে হাতে হাত লাগিয়ে সমানতালে কোম্পানির দেখাশোনা করতেও।

---কথা গুলো শুনতে শুনতে সৌরভের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। এত ভালো কপাল করে দীপা জন্মেছিল এই ভেবে ঈশ্বরকে সে প্রণাম করলো। 

আর কুণালবাবু দীপ্ত কে উদেশ্য করে বললো কি রে দীপা কে তোর পছন্দ হয়েছে তো?

দীপ্তর ফর্সা মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সে নিচু স্বরে বললো

হ্যাঁ বাবা দিপাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই।

--এই সৌরভ এখানেই দীপ্ত কে ধরে তুই মার তো...

কুনাল বাবু র এ হেন কথায় সৌরভ হতভম্ব হয়ে যায়।

তার বিস্ময় ভাঙিয়ে তিনি বলেন দীপ্ত আর দীপার দুজন দুজনকে আগে থেকেই  ভালোলাগতো ।  ওর গিটারে কাল দীপার নাম দেখে ওকে চেপে ধরতে কাল সব ঘটনা ও বললো। 

সব টা ক্লিয়ার হওয়ার পর সৌরভ ও কুনাল বাবু দুজনে মিলে দীপ্ত কে জড়িয়ে ধরলো।

সৌরভ বললো দাদা হয়ে দিপাকে তোর  জীবনসঙ্গিনী হিসাবে তোর হাতে তুলে দিলাম দীপ্ত। আমি জানি একমাত্র তুই ই পারবি ওকে সুখে রাখতে। আশীর্বাদ করি তোদের আগামী জীবন খুব সুখের হোক।

দীপ্ত গাড়ি থেকে নেমে বাবা কে প্রণাম করলো।

---  একটা জনম দুঃখিনী মেয়ে কে জীবসঙ্গিনী রূপে গ্রহণ করে তাকে সুখে, দুঃখে আগলে রাখিস দীপ্ত। 

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ