হ্যাপি এন্ডিং ( প্রথম পর্ব)

 

happy ending first part


হ্যাপি এন্ডিং ( প্রথম পর্ব)


"মা আমি আসছি আর দেরি করলে ট্রেনটা এবার  মিস করবো।"

 হন্তদন্ত হয়ে কাঁধে ব্যাগ খানা  নিয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস  থেকে এক চুমুক জল মুখে নিয়েই  বেরিয়ে পড়ল নিশা।

 ---সাবধানে যাস । কলেজে পৌঁছে একটা ফোন করিস কিন্তু ।

সদর গোড়ায়  দাঁড়িয়ে প্রতিমা দেবী রাস্তার পানে চেয়ে রইলেন।  মুখে বিড়বিড় করে দুগ্গা দুগ্গা  নাম আওড়ালেন।  যতক্ষণ  না নিশার সাইকেলটা পাকা রাস্তার মোড়ে বেকছে  ততক্ষণ  তাকে সে দেখে। এ  তার প্রতিদিনের অভ্যাস। নিশা যখন  স্কুলে যেত তখনও এই অভ্যাসের নড়চড় হত না।

 মা, মেয়ের দুজনের সংসার। নিশা  বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রতিমা দেবীর তেমন বিশেষ কিছু সাংসারিক কাজ থাকেনা।  তবে সকাল বেলা তিনি বড্ড বেশি ব্যস্ত থাকেন।  ভোর বেলা উঠেই  বাসী কাজ, ঘর দোর মোছা , গা ধোয়া , ঠাকুর সেবা দেওয়া, তারপরই তড়িঘড়ি তাকে রান্নার কাজে নেমে পড়তে হয়। নিশার কলেজের টিফিন,  দুপুরের ভাত তরকারি সব কিছুই তিনি সকাল-সকাল সেরে ফেলেন। তাছাড়া দুটো গরম ভাত খেয়েই নিশা কলেজ   যায় । আনাজ  কাটা থেকে মশলা বাটা  রান্নাবান্নার  সমস্ত আয়োজনই প্রতিমা দেবী  একা হাতে সামলান। নিশা  সকালবেলার দিকটা টিউশন পড়ায়। প্রায় গোটা পঁচিশ ছাত্র-ছাত্রী ওর।  সকাল-সন্ধ্যা দুটো বেলাতেই তাকে পড়াতে হয়।  বরাবরই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে পরিচিত নিশা মাধ্যমিক পাস করার পর থেকেই টিউশনি করছে। যাতে মায়ের কষ্ট টা  কিছুটা হলেও লাঘব হয়। তাই আর্থিক দিক থেকে একটু পাশে দাঁড়াতে চায় সে। সে এখন নিজের পড়াশোনার খরচটা নিজেই চালায়। সরল, সুলক্ষনা, মিতব্যয়ী নিশাকে  পাড়ার  সকলে খুব ভালোওবাসেন । তা ছাড়া নিশাও পাড়ার  গরীব দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের বিনা খরচে পড়ানোর জন্য একটি কোচিং সেন্টার এর ব্যবস্থা করেছে। সেখানে নিশা আর ওর একটা বন্ধু দুজনে মিলে পড়ায়। ওর  বন্ধুর নাম অনিশ মজুমদার।  সে অবশ্য এ পাড়াতে থাকে না। নিশার  সাথে তার পরিচয় কলেজে। তারা একই সাথে এম এ ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। অনিশ বিভিন্ন সমাজ কল্যান কার্যকলাপ এর সাথে যুক্ত।  তার বাবার নিজের একটি এনজিও আছে । তার বাবার সাথে তার মা-ও এই কাজে তাকে সহায়তা করেন। নিশার সাথে অনিশের পরিচয় এক বছর আগে।  এমএ তে ভর্তি হওয়ার সুবাদে। তখন থেকেই তাদের বন্ধুত্ব।  কথায় কথায়  অনিশ  জানতে পারে নিশা তাদের এলাকায় দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার চালানোর জন্য একটি কোচিং সেন্টার খুলতে চায়। 

কিন্তু একা ভরসা পাচ্ছে না। তাছাড়া এই সমস্ত ছেলেমেয়েগুলোর পারিবারিক আর্থিক অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। তাদের পড়াতে গেলে খাতা,  পেন, পেন্সিল, বই সমস্ত খরচ তাকেই বহন করতে  হবে। আর নিশার   পক্ষে আর্থিকভাবে  তাদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। একথা শোনা মাত্রই  অনিশ তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিশার সাথে এই কর্মে  সেও সামিল হবে । ও আর্থিক দিক থেকে তাকে সহায়তা করবে। 

---কিরে আজ আসতে এত দেরী করলি? ফোন করলাম... ফোনটা তুললি না... ভাবলাম আগের ট্রেন টায় আসবি। স্টেশনে  তোর জন্য  ওয়েট করছিলাম। দেখতে না পেয়ে  কলেজ চলে এলাম। কলেজে অলরেডি সুকান্ত স্যারের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। মিস করলি। 

এক নিশ্বাসে নিশার  উদ্দেশ্যে অনিশ  কথাগুলো বললো। যেন কথাগুলো সে  মুখস্থ  করে নিজের মনে গেথে রেখেছিল। তাকে দেখামাত্র উগরে দিলো। 

 নিশা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো 

---আর বলিস না!  তারকেশ্বর লোকাল টা দেরীতে হাওড়া পৌঁছাল।  তাই এদিকে মেদিনীপুর লোকালটা মিস  করলাম। অজ্ঞতা পাঁশকুড়া লোকাল টায় এলাম। 

---তো , ফোনটা রিসিভ করতে কি হয়েছিল? একবার রিসিভ করে বলে দিলেই মিটে যেত।  খামোকা এত টেনশন নিয়ে তোর জন্য ওয়েট করতাম না...

 ---হাওড়া স্টেশনে নেমে ভিড় ঠেলে ঠেলে পাবলিকের  গুতো গুতি,  ঠেলাঠেলি সামলে দৌড়ে এসে ট্রেন উঠলাম। ফোন টা ভাইব্রেসন মোডে  ছিল ব্যাগের ভিতর। তাই আর খেয়াল করতে পারিনি রে। সরি! 

 অনিশ বাচ্চাদের মত নিশাকে একটু ভেংচি দিল। ওদের বন্ধুত্বের মধ্যে এইরকম ঝগরা,  মনকষাকষি ,খুনসুটি হতেই থাকে।

 এরপর নিশা  ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে ওর মাকে ফোন করে বলে দিল সে কলেজে পৌছে গেছে। নিশা ফোনটা কেটে দেয়ার পর অনিশ পাশ থেকে ঠেস দিয়ে বলল 

---যেন বাচ্চা মেয়ে... কলেজে পৌছে গেছে সেটাও বাড়িতে ফোন করে বলতে হবে।

  অনিশের  কথায় নিশার  মনে বড় আঘাত লাগলো। এর পাল্টা জবাব সে মুখে দিল না।  তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ক্লাস রুমের দিকে এগিয়ে চলল সে।  নিশার থমথমে মুখটার দিকে চাওয়া মাত্রই অনিশ তার নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো । আসলে তার বাড়ি থেকে  কলেজের দূরত্ব হাঁটা পথে  মাত্র দশ মিনিটের পথ। ও বাইক নিয়ে আসে ।তাই আসতে  মিনিট পাঁচেক ও কম  সময় লাগে।  তাই কলেজ পৌছে বাড়িতে ফোন করার কোন ব্যাপার থাকে না।

আর নিশা তো আসে  সেই সিঙ্গুর থেকে।  কলেজ আসার জন্য বাড়ি থেকে বেরোয় সকাল  আটটা নাগাদ। বাড়ি থেকে সাইকেলে করে স্টেশনে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় কুড়ি মিনিট।  তারপর আটটা বিশের হরিপাল লোকাল এ হাওড়া আসে। তারপর  আবার হাওড়া থেকে নেমে ট্রেন চেঞ্জ করতে হয়। এতদুর একমাত্র সন্তানকে পড়তে পাঠিয়ে মায়ের মন যে উতলা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। 

---প্লিজ নিশা রাগ করিস না।  বললাম তো সরি ! আসলে ইয়ার্কি করতে গিয়ে ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে গেছে।  নিশা তখনও কোন উত্তর না দিয়ে ক্লাস রুমে ঢুকে যায়। আরো সব বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই অনিশের বলা কথাগুলো সে ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায়। টিফিন টাইমে নিশার  ফোনে একটা মেসেজ ঢোকে।  মেসেজ টা চেক করতেই সে  দেখে অনিশের মেসেজ।

 প্লিজ কথা বল নিশা। আর মুখ ফিরিয়ে থাকিস না। নিজের অজান্তে তোকে আঘাত দিয়ে আমি নিজেই  ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। 

মেসেজটা পড়া মাত্রই নিশা এগিয়ে আসতে থাকে অনিশের দিকে।  নিশার এই  আগমন টাকে  একটা যুদ্ধের সূচনা বলে ওর মনে হতে থাকে।  মনে মনে  সে জয় কালী,  জয় কালী ,  জপ করতে থাকে।  ছোটখাটো হলেও একটা ঠান্ডা যুদ্ধ যে এখানে  ঘটতে চলেছে তার জন্য মন থেকেই  সে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেয়। কিন্তু অনিশের  এর সমস্ত ভাবনায় জল ঢেলে নিশা তাকে ইশারায় বসতে বলে। এবং সেও তার পাশে বসে। কিছুক্ষণ দু'পক্ষের মধ্যে কেউই বাক্যব্যয় করলোনা। অনিশ  মাথা নিচু করে অপরাধীর মত নিশার পাশে চুপ করে বসে রইল।  আর ভাবতে থাকলো সামান্য কথাটা তেই  কোথাকার জল কোথায় গড়ালো। 

 তারপর নিশা নিচু স্বরে  বলতে শুরু করল

-- জন্মের পর থেকেই আমি শুধু মা কেই দেখে আসছি।  আমার জীবনে বাবার কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি বাবার দিকের  কোনো আত্মীয়ও আমি কোনদিন দেখি নি।  একটু জ্ঞান হতেই  যখন দেখতাম সব ছেলেমেয়েদের বাবারা মাঝে মাঝে তাদের স্কুলে দিতে যায় নিয়ে আসে  রাস্তাঘাটে লজেন্সের  দোকান দেখেলে  বাবার গলা জড়িয়ে আবদার করে তখন আমারও খুব মনে হতো আমারো যদি বাবা থাকত সত্যি কত ভাল হত!  বাড়ি এসে প্রায়ই বাবার কথা জানতে চাইতাম মায়ের কাছে।  মা কোন উত্তর দিত না । শুধু মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদত।  তখন মায়ের বয়সও খুব বেশী ছিল না । তাই হয়তো  চোখের জল লুকাতে পাড়ত না।  আমার সামনেই  কেঁদে ফেলত। তবু একটা অদম্য জেদ চেপে বসলো আমার ওপর। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ঠিক করে ফেললাম আজ  জানতেই হবে আমার পিতৃপরিচয়। কে আমার বাবা!  কি তার নাম! 

 বাড়ি ফিরে এসে মাকে জিজ্ঞাসা করতেই আমার কপালে সেদিন  জুটেছিল  এলোপাথাড়ি মার।  শেষ পর্যন্ত মায়ের কাছ থেকে বাবার নামটা আজও জানতে পারিনি ।

তবে এটুকু মা বলেছিল উনি বেঁচে নেই। 

তাহলে তোদের সংসার চলতো কিভাবে কৌতূহলের সাথে অনিশ প্রশ্ন করলো নিশাকে।

---আমরা যেখানে থাকি জানিস ই তো জায়গাটা গ্রাম।সেখান থেকে চাকরি বাকরি করা সেইসময় মায়ের পক্ষে ছিল অসম্ভব। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন কার মতো এতটা উন্নতও হয় নি। তাছাড়া আমরা তখন ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। আশে পাশে কারোর সাথেই ওতো ভালোভাবে পরিচয় হয় নি মায়ের। যার ভরসায় আমায় রেখে গিয়ে মা চাকরি করবে। তবে আমার মা শিক্ষিত ছিল। তাই গ্রামের ছেলেমেয়েদের কেই টিউশন পড়িয়ে অর্থ উপার্জন করত। আর মাধ্যমিক পাস করার পরই মাকে এই কাজে আমিও সাহায্য করি। ছোটবেলা থেকেই আমার কোনো গৃহশিক্ষক ছিল না। মায়ের কাছেই আমি পড়াশোনা করেছি স্কুল লাইফ পর্যন্ত। 

এই ভাবেই আমাদের কেটে যাচ্ছে মা, মেয়ের সংসার। সংসারে অভাব থাকতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস কর শান্তি অফুরন্ত। একটু বড় হতে আমার জ্ঞান হতে মা নিজেই বলেছিলেন বাবা , মাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন। বাবারা ছিল উচ্চ বংশীয়। তাই মাকে তারা মেনে নেন নি। আর যেহেতু তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল তাই মায়ের সাথে তার বাড়ির লোকেরাও কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় নি। শুনে ছিলাম আমার দিদা ছিলেন মায়ের সৎ মা। অনেক অত্যাচার সহ্য করেই সে ও বাড়িতে থাকতো। ভেবেছিল বিয়ের পর একটা সুখের সংসার হবে। কিন্তু সেটাও মায়ের কপালে সইলো না। 

নিশার মুখ থেকে এইরকম করুন  কাহিনী শুনে অনিশের মনটা বড়ো ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। সব কিছু শুনে সে বেঞ্চের ওপর থাকা নিশার হাতের উপর সে নিজের হাতটা রাখলো। তারপর ধীর গতিতে বললো

--- কিন্তু তোর বাবার নাম কি? তোদের আসল বাড়ি তাহলে কোথায়? 

--- সেটাই তো মা কোনোদিন বলে নি। আমিও আর মাকে এইসব নিয়ে বিব্রত করতে চাই নি। এই সব প্রশ্নে মা বড়ো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তাই তাকে আর মানসিক ভাবে কোনো কষ্ট দিতে চাই না রে। যেমন আছি এই বেশ ভালো আছি। যে মানুষ টার ছায়া পর্যন্ত কোনোদিন দেখি নি তার সম্পর্কে আগ্রহ দেখিয়ে কোনো লাভ আছে কি? আমার কাছে আমার মা ই   সব...

চলবে ...

পরের পর্ব পড়ুন

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ