জীবনসঙ্গিনী (প্রথম পর্ব)
ইঞ্জিনিয়ারিং এর চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র দীপ্ত
। গায়ের রঙ কাশ্মিরী দের মতো দুধ সাদা ফর্সা। হাইট প্রায় ছয় ফুট। উচ্চতার সাথে বেশ মানানসই চেহারা ।চোখ নাক কাটা কাটা। মুখে হালকা দাড়ি তাও নিয়মিত ট্রিম করা। কলেজের সব মেয়েদের হার্টথ্রব সে। প্রায় সব স্ট্রিমের মেয়েরাই তার প্রেমে পাগল। কিন্তু অত্যন্ত বিত্তশালী পরিবারের একমাত্র সন্তান দীপ্ত গিটার ছাড়া আর কাউকে জীবনসঙ্গীনি হিসেবে বেছে নেয়নি এখনো। নিয়মিত শরীরচর্চা জেন্স স্যালনে গিয়ে সাপ্তাহিক স্কিন, হেয়ার ট্রিটমেন্ট এইসব কিছু কিন্তু সে মেয়েদের চোখের মনি হয়ে থাকার জন্য করত না। বরাবরই সে নিজেকে খুব ভালবাসত। আর নিজেকে ভালো রাখার তাগিদেই তার এত আয়োজন। তাই সব সময় নিজেকে মেনটেন করে চলে। তার জীবনধারায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট থাকলেও অহংকার বোধ টা তার মজ্জায় নেই। খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড রা জানে দীপ্তর মনটা খুবই নরম। তাই নিজে পড়াশোনায় মধ্যম মানের হলেও ভালো ছেলেদের আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে দু বার ভাবতো না।
বছর পাঁচেকের বড় সৌরভ দীপ্ত দের পাড়াতেই থাকে। ক্লাবে আড্ডা ক্যারাম খেলার সূত্রেই দীপ্তর সাথে তার আলাপ-পরিচয়। বয়সে সে দীপ্তর থেকে বড়ো হওয়ায় তাকে সে ভাই বলেই সম্বোধন করত। দীপ্ত ও তার সাথে যথেষ্ট সম্মান দিয়েই কথা বলত। ক্লাবে সব ছেলেরাই ছিল দীপ্তর গান পাগল। গিটারের সাথে তাল মিলিয়ে তার দরাজ গলায় গান শোনার জন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকত। সৌরভ দা র মতো ক্লাবের সব ছেলেদের মতে দীপ্তর গান টাই হলো মন ভালো হয়ে যাওয়ার একটা ওষুধ। কিন্তু সেদিন রোজকার মতোই একটা রোমান্টিক গান গেয়ে সব ছেলেদের প্রশংসা শুনছিলো সে। কিন্তু দেখল একমাত্র সৌরভ দাই আনমনে বসে আছে। তার মনে কোনো উৎফুল্লতা নেই। দীপ্তর গান শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যে ছেলেটা 'সাবাস ভাই, দারুন গেয়েছিস ! এইসব বলে তাকে প্রথমে জড়িয়ে ধরতে আসতো সেই মানুষ টাকে দীপ্তর আজ বড্ড বেশি অচেনা লাগলো। আর একটু রাত হতেই ক্লাবের সব ছেলেরা বাড়ি ফিরতে তৎপর হয়ে উঠল । একমাত্র সৌরভ দা কেই দেখল দীপ্ত তার যেন বাড়ি ফেরার কোনো তাগিদই নেই। হই-হুল্লোড়ের শব্দ ক্ষীণ হতে হতে কখন যে মিলিয়ে গেছে সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই তার। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার ধারে বসে আনমনে ধোয়া ছাড়ছে। আর উদাস দৃষ্টিতে মেঘে ঢাকা চাঁদ এর লুকোচুরি একমনে দেখছে। পাশে থাকা মোবাইলটা ভাইব্রেট মোডে বেজেই চলেছে।
---অনেক রাত হয়েছে সৌরভ দা , এখনো বসে আছো! বাড়ি যাবেনা?
দীপ্তর দিকে না তাকিয়েই হালকা ঠোঁট প্রসারিত করে একটু হেসে জবাব দিল ---আজকাল বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না রে। এখানেই বেশ ভালো আছি। কোন অভাব নেই , কোন অভিযোগ নেই। শালা বাড়ি ফিরলেই খালি নেই , আর নেই । জীবনটাই হেল হয়ে গেল।
সৌরভের এই কাটাছেঁড়া কথাগুলোর কি জবাব দেবে দীপ্ত ভেবে পেল না। একটু ইতঃস্তত হয়ে বললো
-- সৌরভ দা তোমার ফোনে একটা কল এসেছিল। এইমাত্র বেজে বেজে কেটে গেল।
যাক ! সব কেটে যাক । চুলোয় যাক সবকিছু... আমি আর পারছি না এত চাপ সহ্য করতে। আর পারছি না!
সৌরভ দার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না দীপ্ত। শুধু এটুকু বুঝল কোন ব্যাপারে আজ সৌরভ দার মুড টা পুরো ঘেঁটে আছে। তাই তাকে উত্ত্যক্ত করা ঠিক হবে না । সে শুধু তার একাকীত্ব টা কিছুটা ভাগ করে নেওয়ার জন্য তার পাশে বসে আলতোভাবে তার ঘাড়ে হাত রেখে বলল তোমার সমস্যাটা কি? এই ভাইটাকে ভরসা করে বলা যাবে না সৌরভ দা?
দীপ্তর কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেসে বলল তুই এ সব কিছু বুঝবি নারে... আমার জীবনটাই বড় জটিল। তুই শিল্পী মানুষ । শিল্পীদের মাথা সবসময় সুন্দর, স্বচ্ছ থাকা উচিত। তবেই তো সেই শিল্পীর সৌন্দর্যতা শ্রোতার হৃদয় জয় করতে সক্ষম হবে।
---আমি তো অন্যান্য দিনের মতোই আজও প্রাণ খুলে গান গাইলাম। কই! তোমার মত শ্রোতার মন জিতে নিতে পারলাম না তো?
প্লিজ বলোনা তোমার সমস্যাটা কি?
--শুনবি ?
বেশ উৎসাহ আর কৌতূহল নিয়ে দীপ্ত বললো অবশ্যই শুনবো।
বাবা, মা আর আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট আমার বোনকে নিয়েই ছিল আমাদের পরিবার। বাবা একটা কারখানায় কাজ করতেন। মাইনে খুব একটা বেশি পেত না। মাসের শুরুতে যা মাইনে দিত তাতে আমাদের পুরো মাস চালানো কষ্টকর হতো। আমার বোন দীপা হওয়ার তিন বছর পরই মা আমাদের ছেড়ে চলে গেল।
এই টুকু শুনেই দীপ্ত একটা দীর্ঘস্বাস ছেড়ে ঘন কালো আকাশের ওপর ফুটে ওঠা তারা গুলোর দিকে চেয়ে বললো সত্যিই খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এ পৃথিবীতে মা ই হলো সবচেয়ে আপন জন। তাকে ছাড়া নিজের দুনিয়া টাই শূন্য। মা ই যে তার সন্তানের একমাত্র ভরসার জায়গা।
সৌরভ দার হাতে হাত রেখে একটা সহানুভূতি জানানোর চেষ্টা করল দীপ্ত।
দীপ্তর এই রূপ আচরণে সৌরভ হঠাৎ উচ্চস্বরে হাসতে আরম্ভ করল। তার এমন ব্যবহারে রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেল দীপ্ত। কারো মা চলে গেলে তার বিরহে কেউ এইভাবে প্রাণ খুলে হাসতে পারে এটা ছিল তার কাছে কল্পনারও অতীত। হা করে সে সৌরভ দার মুখের দিকে চেয়ে রইল ।
কোনরকমে হাসি বন্ধ করে বহুদিন এর একটা চাপা কষ্ট উগরে দিয়ে সে বললো
--- তুই সত্যিই খুব বোকা রে দীপ্ত। মানে বড্ড বেশি সাদামাটা যাকে বলে। কিন্তু তোর লুক দেখে তা সত্যিই বোঝার উপায় নেই। তোর নরম খুপরিতে এই ব্যাপার টা সহজে ঢুকবে না।
জামার বুক পকেট থেকে রুমাল টা বার করে নাক মুখ কপাল টা ভাল করে মুছে নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করলো
হ্যা , মা চলে গিয়েছিল এটা ঠিকই। তার মানে এই নয় যে, এই পৃথিবীতে তার কোনো অস্তিত্ব নেই । সে শুধু আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলো । যে বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেই বাড়িতে আমার জন্মের পরপরই আমার বোনের জন্ম হলো। দুটো বাচ্চাকে নিয়ে সংসার চালানো দুর্বিষহ হয়ে পরেছিল। তার ওপর আবার হঠাৎই একদিন কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। লে, গোদের ওপর বিষ ফোরা... কারখানা চালু অবস্থাতেই ঠিক মতো চলে না। এবার তো পুরোপুরি বন্ধ। কয়েকদিন বাবা ও আরো কয়েকজন কারখানার কর্মীরা আন্দোলন করলো, শ্রমিক ধর্মঘট। কিন্তু এইভাবে তো আর আয় হবে না। অভাবের দোরগোড়ায় হতাশা আর খিদে হুমড়ি খেয়ে পরলো।দুটো ছেলে মেয়ের মুখে দু'বেলা খাবার তুলে দেওয়ার সামর্থ্যও তখন বাবার ছিলনা। বাধ্য হয়েই বিকল্প পথ বেছে নিয়েছিল সে। জুয়াখেলায় মেতে উঠেছিল। কখনো জিতত আবার কখনো সর্বস্ব খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফিরত। মানসিক যন্ত্রনা লাঘব করতে মদের বোতলেও আসক্ত হয়ে পরলো।
জমানো টাকা বাড়িতে তেমন ছিল না। শেষ সম্বল বলতে ছিল স্ত্রীধন মানে মায়ের গলার চেন দুগাছা পাতলা চুড়ি। সেটুকুই বেচে আবার নতুন স্বপ্নের আশা দেখলো বাবা।
আমাদের ওই যে চৌমাথার মোড় টা দেখেছিস ওখানেই বাবা বাঁশ পুঁতে, তিরপল খাটিয়ে একটা তেলেভাজার দোকান খুললো। এর ফলে কিছুদিনের জন্য আমাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছিল। কিন্তু কিছুদিন পর আবার যেই কে সেই অবস্থা। ভাগ্য সহায় হলো না রে।
এটুকু বলেই সৌরভ দা সিগারেটের টুকরোটা জানলা দিয়ে গলিয়ে বাইরে ফেলল । তখনও তার মুখের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে একভাবে তাকিয়ে রইল দীপ্ত।
নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো
---তারপর !
তারপর কি হলো সৌরভ দা?
ক্রমশ....
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ