জীবনসঙ্গিনী (দ্বিতীয় পর্ব)
--এমনভাবে জিজ্ঞাসা করছিস যেন আমার থেকে কোন গল্প শুনছিস তাই না?
তার পরের কাহিনীটুকু অসমাপ্তই থাক। পরে না হয় একদিন শুনবি।
---এভাবে কেন বলছো সৌরভ দা। তোমার জীবনের এসব করুন কাহিনী আমি সত্যিই আগে জানতাম না। পাশাপাশি পাড়াতে থাকলেও ছোট থেকে স্কুল আর বাড়ি সাথে গান-বাজনা এই নিয়েই ব্যাস্ত থাকতাম। এখন বড় হয়েছি।অনেক বন্ধুবান্ধব হয়েছে। সকলের সাথে মিশছি। এই ক্লাবেও নিয়মিত আসছি আড্ডা দিতে। সেই সূত্রেই তোমারসাথে আলাপ। স্বাভাবিকভাবেই তোমাকে আজ এত মনমরা দেখে আমার মনে কৌতুহল জেগেছে।
পকেট থেকে আবার একটা সিগারেট বার করে আগুন ধরিয়ে মুখ থেকে এক রাশ ধোয়া বের করে আবার বলতে শুরু করল সৌরভ দা
তারপর তেলেভাজার দোকান বেশ কোয়েকদিন রমরমিয়ে চললো। সেই সময় মাও বাবাকে সাহায্য করতে দোকানে বসত। আমি তখন ছোট দীপা কে আগলে বাড়িতে থাকতাম । কিন্তু জুয়া খেলার বন্ধুরা বাবার দোকানে প্রতিদিন আড্ডা দিতে আসতো । মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ধার বাকি তে তেলেভাজা নিয়ে যেত। শেষের দিকে টাকাও দিতে চাইত না। টাকা চাইলে বাবা কে গালাগাল দিত। মাকে অশালীন ভাষায় খিস্তি দিত। কু দৃষ্টিতে দেখতো। তাদের দৌরাত্ম্য দিনের পর দিন আরো বেরেই চললো। একটা সময় মাও বিরক্ত হয়ে অপমানের থেকে রেহাই পেতে দোকানে যাওয়া বন্ধ করে দিল । ঠিক এই সুযোগটা ই কাজে লাগিয়েছিল জুয়া পার্টির লোক গুলো। তারা বাবার ব্রেন ওয়াশ করে তেলেভাজার দোকান বন্ধ করে দিলো। বাবা আবার খারাপ পথে পা বাড়ালো। বাবা যখন কারখানায় কাজ করত তখন কিন্তু নেশা ভাং করত না। সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল ও ছিল । কিন্তু হঠাৎ করে কারখানায় কাজ বন্ধ হওয়ায় অভাবই তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে । আর তার বশবর্তী হয়েই এর বিকল্প পথ হিসেবে বেআইনী জুয়া খেলায় মেতে ওঠে।
খানিকক্ষণ থেমে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে
--তোর বাবা তো বড়লোক দীপ্ত। বিত্তশালী পরিবারে তোর জন্ম ।তুই হয়তো এই কষ্টটা গভীরভাবে অনুভব করতে পারবি না। তোর মনে হতেই পারে সৎ ভাবেও তো ইনকাম করা যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই আয় এর উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংসার চালানোর মতো নূন্যতমতম অর্থ ও বাড়িতে মজুত ছিল না। আর কাজ খুজলেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে কাজ পাওয়া যায় না। তাই হয়তো বাচ্চাগুলোর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য ওই পথ বেছে নিয়েছিল বাবা। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে ব্যবসা টা করতে চাইল। কিন্তু দাঁড় করাতে পারলো না।
অতঃপর মা লেকের বাড়ি রান্নার কাজে লেগে গেল। ততদিনে বাবার নেশার পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। নেশার কারণে মা য়ের উপার্জনের ওই যৎসামান্য টাকাতেও তার দৃষ্টি পরলো। যে বাড়িতে মা কাজ করতো তাদের দয়াতেই আমি আর দীপা সরকারী বাংলা মিডিয়াম প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলাম।
তুই হয়তো নাম শুনে থাকবি সত্যেশ মাস্টারের। তাকে আমাদের এলাকায় একনামে সকলেই চিনতেন। বড় ভালো মানুষ ছিলেন উনি।
-- হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু ওনাকে চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমার জেঠুর ছেলে শুভ দা ওনার কাছে পড়তো।
--- উনি বিনা পয়সায় আমায় আর দীপাকে পড়াতেন । ভালো মানুষরাই হয়তো পৃথিবী ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। একদিন সকালবেলা আমি আর বোন পড়তে গিয়ে দেখলাম সত্যেশ স্যারের বাড়ির সামনে খুব ভিড়। এত লোক জন জমা হওয়ার কারণ এত চেচামেচির কারণ কিছুই বুঝতে পারলাম না ।কোনরকমে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই লোকজনের কানাঘুষয় শুনলাম গতকাল রাতে নাকি সত্যেশ স্যার আত্মহত্যা করেছেন। থানায় খবর দেয়া হয়েছে। কিন্তু তখনো থানা থেকে পুলিশ আসেনি। দীপা কে স্যারের বাগানের পাশে লাগোয়া চাতাল টা তে বসিয়ে জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম সে কি মর্মান্তিক দৃশ্য ! ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম সেদিন।
--- কিন্তু সৌরভ দা উনি তো ভুল করেছিলেন । আত্মহত্যা যে মহাপাপ। আর উনি একজনশিক্ষক হয়ে এটা কি করে করলেন !
-- কথাটা ঠিকই বলেছিস। কিন্তু মানুষ অনেক সময় অসহায় হয়ে এই পথ বেছে নেয় । ওনার মৃত্যুর কারণ টা অবশ্য আমি সঠিক জানিনা।
সে যাই হোক ওনার মৃত্যুর পর আমার আর বোনের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা আরো দুর্বিষহ হয়ে পরলো। ঘরের এই অভাবের পরিবেশের সাথে মা আর মানিয়ে নিতে পারছিল না। ইতিমধ্যে কাজে যাতায়াতের পথে মায়ের সাথে একজনের ঘনিষ্ঠতা হয়। একদিন আমাদের এখানে রেখেই সে ঘর ছাড়লো । সেদিন খুব ঘেন্না হয়েছিল মায়ের প্রতি । সেদিনের পর থেকে রাস্তাঘাটে বেরোলে আমাকে লোক দেখে হাসাহাসি করত। গুজগুজ ফিসফাস করত। আমি ততদিনে প্রাইমারী র গণ্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি। স্কুলেও আমার সাথে কেউ মিশতে চাইত না।
এর মধ্যে একদিন সন্ধ্যাবেলায় যখন আমি আর দীপা পড়ছিলাম হটাৎ ই পাশের ঘর থেকে নিচু স্বরে কথাবার্তা বলার আওয়াজ ভেসে আসছিল। কৌতূহলবশত বাইরে বেরিয়ে দেখি পাশের ঘরের দরজা ভেজানো। ভিতর থেকে বন্ধ করা নেই। আমি আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ভেজানো দরজাটা হাতে করে একটু ফাক করতেই যা দেখলাম আমি তো বিস্ময়ে সেই দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
---উত্তেজিত হয়ে দীপ্ত জিজ্ঞাসা করলো কি দেখলে দীপ্ত দা?
--- দেখলাম মা বাবার সাথে পাশাপাশি বসে কথা বলছে। আর বাবা তাকে তিরস্কার করার বদলে তার থেকে পাওয়া টাকার বান্ডিল গুলো লোভীদৃষ্টিতে গুনতে ব্যস্ত । মাকে বলতে শুনলাম
-- জানি, সৌরভ এখন বড় হয়েছে। ও আমার সম্পর্কে সব কিছু জেনে গেছে। আমায় ঘেন্না করে এখন। তাই ওদের সাথে দেখা না করে আমায় চলে যেতে হবে।
মায়ের কথাগুলো কোন গ্রাহ্য না করেই উত্তেজিত গলায় বাবা বলল
সামনে না যেতে পারো জানালা দিয়ে থেকে উঁকি মেরে দেখে আসতে পারো। তুমি যতো দিতে পারবে বিভা , তোমার ছেলে মেয়েরা ততোই ভালো থাকবে।
বাবার কথায় মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
বাবার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে টাকার বান্ডিল গুলো গুনে গুছিয়ে তুলে নিয়ে আলমারিতে রেখে দিলো। আর কিছু টাকা পকেটে রেখে মাকে বলল
এবার চলে যাও বিভা । নাহলে পাড়ার লোকেরা জানতে পারলে আমায় ভিটেছাড়া করে ছাড়বে।
--- তোমার কাছে টাকাটাই সব ! পাওনা গন্ডা বুঝে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমায় বিদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে?
--- আরে ধুর ভুল বুঝনা তো ....তোমার সেই ন্যাকা কান্না এখনো গেল না দেখছি। সতীত্ব নষ্ট করে ফেলেছো এখনো এত ন্যাকামো কেন শুনি?
দেওয়ালে টাঙানো ছোট আয়নাটার সামনে চিরুনি দিয়ে চুল আচড়াতে আচড়াতে বাবা বলল
---এই লাইনে এত টাকা আমি আগে জানতামই না । শালা, জানলে কি আর কারখানায় বেগার খাট তে যেতাম। তোমায় আগেই নামিয়ে দিতাম।
---ছি ! এতোটা নীচ তুমি? তোমার বলতে লজ্জা করল না কথাটা।
--- যা শালা.... আমিতো তোমাকে এই লাইনের হদিস দি ই নি। তুমি তো নিজে মানিকের হাত ধরে রাস্তায় নেমেছো।
---কান্নায় ভেঙে পরে মা বলেছিল আমি পারিনি গো তোমার মতো স্বার্থপর হয়ে যেতে। তুমি শুধু তোমার ব্যর্থতা কে ভুলে থাকার জন্য মদ কে সঙ্গী করে নিয়েছিলে। আর দিনের পর দিন আমাদের উপর অত্যাচার করে গেছো।
সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। যে সময়ে ছোট ছোট বাচ্চা রা একটু দুধ ,
ভালো মন্দ খাবার খায়... সে সময়ে ওরা পেটের জ্বালায় জলতো। আর তুমি একজন পরুষ মানুষ হয়ে আমার কষ্টের টাকা গুলো নিয়ে গিয়ে বাইরে ফুর্তি করতে। লজ্জা করতো না তোমার?
কোনো বছর দুর্গা পুজোয় ছেলে, মেয়ে গুলোকে একটাও জামা কিনে দিয়েছিলে? আমার কথা না হয় বাদ ই দাও...
একবারের জন্যও মনে হয় নি ওরা তো শিশু। ওদের তো অবুঝ মন। ওদের ও ইচ্ছে করতো পুজোয় একটা নতুন জামা পরতে।
পুজো আসলে সৌরভ , দীপা যখন আমায় জড়িয়ে ধরে বায়না করতো পাড়ার আরো সব ছেলে মেয়েদের মতো নতুন জামা কিনে দেওয়ার জন্য মা হয়ে এই ব্যর্থ তার জন্য আমারও বুক টা হু হু করতো। তখন মনে হতো কিসের এই সতীত্ব। একজন মায়ের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান তার সন্তান। তার সন্তানের মুখের হাসি। তাদের নুন্যতম শখ, আহ্লাদ ই যদি মেটাতে না তাহলে মা হয়ে হয়ে নিজের সন্তানের মুখের দিকে চাইবো কি করে?
এক কলম পড়াশোনা জানলে কবেই তোমায় ছেড়ে দিয়ে কোনো কাজ জোটাতে চেষ্টা করতাম। আমি অশিক্ষিত তাই এই পথ টাই বেচে নিতে বাধ্য হলাম।
হ্যা, এই নোংরা পথে অর্জিত অর্থেই ছেলে মেয়েদের আমি বড়ো করতে চাই। আমি সমাজের ভয় করি না। কারণ আমার অভাবের সময় কেউ আমায় বাড়ি বয়ে এসে সাহায্য করেনি। তবু আমি লুকিয়ে টাকা দিতে এলাম কারণ সৌরভ দীপা কে বাইরের লোক এই নিয়ে কথা শোনালে ওদের কম বয়স, নরম হৃদয় ওরা কষ্ট পাবে। তাই এইভাবে লুকিয়ে আসতে হচ্ছে আমায় টাকা দি
তে।
ক্রমশ....
ছবি : সংগৃহীত
1 মন্তব্যসমূহ
Trade Insta is one of the Advanced trading apps in India, get free calls and services.
উত্তরমুছুনstock market trading apps in India