ষড়যন্ত্রের শিকার (প্রথম পর্ব)
অর্ক আর বিদিশার পরিচয় ছিল সেই নার্সারী স্কুল থেকে। দুজনেই একই পাড়াতেই তখন তারা থাকতো। বিদিশার বাবা ছিলেন নামকরা ব্যবসায়ী। এই শিলিগুড়ি শহরেই ছিল তার ছোট বড় তিনটি কারখানা। আর অর্কের বাবার ছিল একটি কাপড়ের দোকান । সে দিক থেকে বিদিশা দের মতো ওতো বিত্ত শালী না হলেও আর্থিক দিক থেকে তারাও ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল। তাই তো অর্কের প্রাথমিক শিক্ষাটা শুরু হয়েছিল নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকেই। একই পাড়ায় ও একই স্কুলে এমনকি একই ক্লাসে পড়ার সুবাদে বিদিশা ও অর্কের মধ্যে বন্ধুত্বটাও ছিল বেশ গভীর। দুই পরিবারের মধ্যে মেলামেশা টাও এই সূত্রেই গড়ে উঠেছিল।
নার্সারী স্কুলে একসঙ্গে টিফিন ভাগ করে খাওয়া থেকে শুরু করে পেন পেন্সিল বদলানো এমনকি স্কুল ইউনিফর্মে বদমাইশি করে পেনের কালি লাগানো এইসব ছোটখাটো নানা আনন্দের মধ্য দিয়েই তাদের শৈশবের দিন গুলো অতি বাহিত হচ্ছিল। বিদিশার মা প্রভাদেবীর সাথে অর্কর মা গীতা দেবীর ও একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই সময়। তারাও দুজনের মধ্যে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে আলোচনা করতো। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে, ও পুজোর সময় একসাথে কেনাকাটাও করতে বেরোতেন। মোট কথা অর্ক ও বিদিশা দের বন্ধুত্বের মারফত গীতা দেবী ও প্রভা দেবীর মধ্যেও বন্ধুসুলভ সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে প্রভা দেবী অর্ক দের বাড়ি আসতেন বিদিশাকে নিয়ে। তখন অর্ক আর বিদিশা তাদের ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে বসে খেলাধুলা করতো। আর তাদের মায়েরা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু গীতা দেবী কখনো প্রভাদেবীর শত অনুরোধ সত্ত্বেও তাদের বাড়ি যান নি। কারণ প্রভা দেবী বাইরে বেরোতে খুব একটা অভ্যস্থ ছিলেন না। কিন্তু সাজানো-গোছানো এই মসৃণ জীবন পথেও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে। দুই পরিবারের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। শুরু হয় দুটি পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন। যার প্রভাব পরে অর্ক ও বিদিশার জীবনেও।
একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অর্ক দেখে তার মা পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছে বাইরের সদর দরজায় ঠেস দিয়ে। পরনের কাপড় আলুথালু, সুদীর্ঘ চুল এলোমেলো, অপলক সেই স্থির দৃষ্টিতে কেবলই জলধারা নিঃসরণ হয়ে দুই গাল বেয়ে বুক স্পর্শ করছে। মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে কৌতূহল বশত ঘরে ঢুকেই সে লক্ষ্য করে ঘরের আসবাবপত্র সমস্ত এদিক-ওদিক ছড়ানো। ড্রেসিং টেবিলের অত বড় লম্বা কাচটা ভেঙে চুরমার হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। আলমারির একটা পাল্লা ভেজানো , অন্য পাল্লাটা খোলা । আলমারিতে সজ্জিত থাকা সব জামা-কাপড় ভাঁজ খোলা অবস্থায় লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে আছে চতুর্দিকে। ঘরের এইরূপ ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে কিছু না বুঝতে পেরে ঘর পেরিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই দেখে হাত, খুন্তি, হাঁড়ি, কড়া সব মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে।
অর্ক স্কুল থেকে ফেরার পরই তার পিছু পিছু পাড়ার কিছু প্রতিবেশীরা তাদের ঘরের সামনে এসে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল ।আর চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করতে করতে হাসাহাসি করছিল। ঘরের এইরকম অদ্ভুত পরিবেশ দেখে ছোট্ট অর্কর তখন সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সে এক ছুট্টে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে পিঠে থাকা ব্যাগ খানা ধপ করে নিচে নামিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে, তার ছোট ছোট হাত দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে মা কে বলল ---মা কী হয়েছে? তুমি এমন করে বসে আছো কেন মা? আমাদের ঘরে জিনিসপত্র কারা ভাঙচুর করল? কি গো মা কথা বলছো না কেন? প্লিজ মা কি হয়েছে বলো না? আমার যে ভীষণ ভয় করছে।
তখনই জানালার বাইরে থেকে স্রোতের মত আসতে থাকলো বিদ্রুপ ব্যাঙ্গমায় মাখা কথাগুলো। " কি আবার হবে অর্ক তোর গুণধর বাবা শ্রীমান অশোক সেন এই পাড়ার কাপড় ব্যবসায়ী। তিনি কিনা নামকরা ব্যবসায়ী সুধাকর রায়ের স্ত্রীকে নিয়ে ভেগেছে। কিন্তু তোর বাবার এলেম আছে বলতে হবে। না হলে অশোক বাবু ওতো বড়লোকের বউ কে পটিয়ে নিয়ে পালাতে পারে? আরে তোর ও তো দেখছি ওই বাড়ির মেয়ের সাথে বেশ খাতির আত্তি আছে। তা বাবা-ছেলে যে দেখছি একই পথে হাঁটছে।কথা গুলো বলার পরই একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মধ্যবয়স্ক পুরুষ কন্ঠ ও নারী কন্ঠ অট্টহাসি দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো।
--- খবরদার ! আমার ছেলেকে নিয়ে যদি আর একটাও বাজে কথা শুনি তাহলে তোমাদের সব কটার মুখ আমি থেতলে দেবো।
ঠোঁট উল্টিয়ে মুখ বেকিয়ে পাড়ার বউ ঝি গুলো মুখ ঝামটা দিয়ে বললো --- এ যে দেখছি চোরের মায়ের বড় গলা। কোনো চরিত্রহীন পুরুষ এর পরিবারকে আমরা আর এই পাড়ায় থাকতে দেবো না। আমাদের বাড়ির পুরুষ দের তাহলে এই মেয়ে মানুষটা মাথা চিবিয়ে খাবে। স্বামী তো পালিয়েছে বড়ো লোকের বউ পটিয়ে। এই মেয়ে রও তো শরীরের খিদে আছে। না জানি এ ও হয়তো বরের মোতো কারও মরদ কে নিয়ে ফস্টি নষ্টি করার তালে আছে।
---ঠিক ই বলেছো গো হেবলোর মা। এটা তো এতক্ষন ভেবে দেখি নি। বর তো ফেলে রেখে গেল। ও যদি এবার পেটের দায়ে এই পাড়া তেই শরীর বেচতে বসে... ছি ছি ছি! আমার তো ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে গো। বিদেয় করো শিগ্রই এই কুলটা কে। ঝেটিয়ে বিদেয় করো। যেমন মাগ তেমন তার মিনসে।
কাঁদতে কাঁদতে গীতা দেবী হাতজোড় করে অনুনয় করে বলে ---
---দয়া করে এই একরত্তি বাচ্ছা টার সামনে আর কোনো কটু কথা বলবেন না। আপনারা তো এত বছর ধরে আমাদের সাথে মিশছেন। আমাদের দেখে মনে হয় আমরা এতোটা নীচ?
----তা কি করে জানবো বাপু তোমরা কেমন স্বভাবের! দেখে তো ভালো মানুষই মনে হতো। ছেলেকে নামকরা স্কুলে ভর্তি করিয়েছ। আর ছেলের বন্ধুর বড়ো লোক মা কে ঘরে এনে টাকার জন্য নিজের স্বামীকেই লেলিয়ে দু হাতে পয়সা লুটেছো। আর এখন পাখি দুটো বাসা থেকে উড়ে যেতেই মহা ফ্যাসাদে ফেঁসে এমন ভান করছো যেন ভাজা মাছটাই উল্টে খেতে জানো না তাই তো?
---- বলি....ও গজার বাবা শুনছো এই মহিলা ও মনে হয় এই কান্ড কারখানায় জড়িত। আমরা জনকোয়েক বউ ঝি রা মিলে উত্তম মধ্যম দেবো নাকি?
---- না , না। সেই সব কিছুর দরকার নেই। এই সব নষ্টা চরিত্রা মেয়েমানুষ দের আবার ফ্রী তেই অনেক গুন্ডা পোষা থাকে। আমরা এইসব কূটকাচালিতে জড়াতে চাই না।
এই যে তোমায় বলছি এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়ি বিক্রি করে অন্যএ ছেলে নিয়ে মানে মানে কেটে পরবে। এটাই আমাদের পাড়ার সকলের সিদ্ধান্ত।
কি এই সিদ্ধান্তে সকলে রাজি তো?
পাড়ার সকল প্রতিবেশীরা উচ্চ স্বরে চিৎকার করে সম্মতি জানালো। তাদের চোখে মুখে উল্লাসের ছাপ স্পষ্ট।
গীতা দেবি আর কথা না বাড়িয়ে অর্ককে বুকে আগলে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দোর দিলো। কান্নায়, অপমানে তার তখন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে রাতেই নিজে বিষ খেয়ে অর্ক কে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে এ জীবন ত্যাগ করবে। আত্মহত্যা যে মহাপাপ। পরক্ষণেই তার মনে হলো সে তো কোনো পাপ করে নি। আর দুনিয়াটা শুধু এতটুকু জায়গার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অভুক্ত ঘুমন্ত ছোট্ট অর্কের মুখের দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চিপে গালে লেগে থাকা নোনা ধারার স্রোত টাকে আঁচলে মুছে মনে মনে স্হির করলেন এই অশিক্ষিত, নিচু মানুষ গুলোর সাথে আর সে থাকবে না। অর্ককে নিয়ে অন্যত্র চলে যাবে।
সেইদিন স্কুল থেকে ফিরে অর্কের পেটে আর কিছুই পরে নি। ছেলেটা যে অভুক্ত থেকেই ঘুমিয়ে পরেছে সে খেয়ালও তখন গীতা দেবীর ছিল না। সাত পাঁচ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে গীতা দেবীর ও চোখে নিদ্রার আবির্ভাব ঘটেছিল। রাত তখন সবে আট টা। জানালায় টোকা দেওয়ার আওয়াজে গীতা দেবী ধড়মড় করে জেগে ওঠে । গীতা দেবী জেগে উঠতেই অর্কর ও ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে সে মা কে আকড়ে ধরে।
বিছানা ছেড়ে নেমে পা টিপে টিপে আস্তে আস্তে বন্ধ জানালার এপাশ থেকেই কাঁপা কাঁপা স্বরে গীতা দেবী বলে----কে, কে ওখানে?
জানলার ওপর প্রান্ত থেকে বিদঘুটে কর্কশ স্বরে পুরুষকণ্ঠ স্বর টা যতো টা সম্ভব গলা নামিয়ে বললো
----আমি কেদার। গজার বাবা। এবার চিনতে পারলেন বৌদিমনি?
প্রাণপ্রনে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে গীতা দেবী বললেন ---কেন এসেছেন? কি চান এখানে?
---মুহূর্তের মধ্যে জনা চারেক পুরুষ ঘরঘরে গলায় হাচতে, কাশতে হেসে উঠলো।
তাদের সম্মিলিত হাসির শব্দে গীতা দেবী মারাত্মক রকম ভয় পেয়ে ছুটে গিয়ে রান্না ঘর থেকে বঁটি টা নিয়ে আবার জানালার কাছে এসে সাহস সঞ্চয় করে বললো --- কি ব্যাপার আপনাদের?
---দাদা তো বড়লোকের সুন্দরী যৌবনবতী বউ কে নিয়ে এখন ভালোই সুখ ভোগ করছে। এবার আপনার কি হবে বলুন তো বৌদিমনি। আপনার চাহিদার কথা মাথায় রেখেই আপনাকে খুশি করতে এসেছি।
----এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যান। নাহলে আমি চিৎকার করে লোক ডাকবো।
---ওহ ! বৌদিমনি ভুল করছেন। আপনাকে কেউ আর বিশ্বাস করবে না। উল্টে আমরা আপনাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারি। ভালোয় ভালোয় আমাদের কথায় রাজি হয়ে যান। এতে আপনারই লাভ
। ভেবে দেখবেন। আজ চললাম। আবার আসবো কিন্তু।
ক্রমশ....
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ