দীর্ঘ কিছুদিন যাবত ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার জন্য ব্লগে নিয়মিত পোস্ট করতে পারিনি। তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। আজ নিয়ে এসেছি একটি ধারাবাহিক গল্প। গল্পটির নাম রঞ্জাবতী। এটি সম্পূর্ণভাবে পরিবার কেন্দ্রিক একটি গল্প। গল্পটি উনিশ শতকের সত্তর দশকের প্রেক্ষাপটকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সকল বন্ধুদের অনুরোধ রইল গল্পটি পড়ার জন্য।
রঞ্জাবতী :
কিশোরী লালের সহিত যখন রঞ্জাবতীর বিবাহ হয় তখন রঞ্জাবতীর বয়স ছিল সবে মাত্র ষোল বছর। যে বছর সে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উর্তীর্ণ হয়, সেই বছরই শংসাপত্র বেরোনোর মাস দুয়েক পরেই বৈশাখ মাসে তার বিবাহ হয় ব্যবসায়ী চৌত্রিশ বছর বয়সী কিশোরীলালের সাথে। তখনকার তিলোত্তমায় এখনকার মতো আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট হয়নি। রঞ্জাবতী বাপের বাড়ি ছিল হুগলি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সরিষা পুরে। যেহেতু বিস্তৃত মাঠ জুড়ে হলুদ রঙের সরষে ফুলের শোভা পেত ছোট গ্রাম টা জুড়ে তাই হয়তো গ্রামটির এইরূপ নামকরণ। রঞ্জাবতী জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছে গ্রাম বাংলার অপরুপ স্নিগ্ধ রূপ।যার শীতলতা, ও উষ্ণতায় সে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছে। ভোরের শুভ্র আকাশে লালভ আভায় সজ্জিত হয়ে থাকা পুব গগনের রবির কিরণ সে দুচোখ ভরে দেখেছে। প্রত্যক্ষ করেছে পড়ন্ত অপরাহ্ণে ক্লান্ত গাভী কিংবা ছাগ শিশুর খানিক টুকু ছায়া ও অল্প একটু জলের জন্য তাদের তৃষ্ণার্ত শুকনো মুখ খানি।
খুব কাছ থেকে সে দেখেছে যে বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোন লেশমাত্র থাকেনা, অথচ প্রকৃতি নিয়ম মাফিক বারিধারা , সূর্যতাপ, ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করায় উত্তম ফসল ফলেছে ক্ষেতে তখন গ্রামের কৃষক ও ভাগ চাষীদের মুখে ওই সারল্য মাখা হাসি। আবার কখনো খরায় বন্যায় ক্ষতি হতেও দেখেছে সে। তিল তিল করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষি ভাইদের গড়ে তোলা ফসল নষ্টও হয়ে যেতে সে দেখেছে প্রত্যক্ষ ভাবে।।
রঞ্জাবতীর পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামেরই পাঠশালায়।
যেখানে নিত্যানন্দ মাস্টারমশাইয়ের কাছে মার খেয়ে তার রক্তবর্ণ চোখ এর তীক্ষ্ণ চাওনি কে ভয় পেয়ে একটার পর একটা ক্লাসে আশানুরূপ নম্বর পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে গ্রাম থেকেই একটু দূরে হাইস্কুলে ভর্তি হয়।
রঞ্জাবতীর বাবা ছিলেন ওই উচ্চ বিদ্যালয়ের ই শিক্ষক। বিদ্যালয়ের নাম ছিল শ্যামাঙ্গিণী উচ্চ বিদ্যালয়। রঞ্জাবতীর বাবা রাজনারায়ন শিক্ষকতার পাশাপাশি চাষবাস ও করতেন। জমির পরিমাণও কম ছিল না । তাই বলা যেতে পারে রঞ্জাবতী দের অবস্থা সচ্ছলই ছিল। শ্কিন্তু অর্থ স্বচ্ছলতা থাকলেও রঞ্জাবতী ও রাজনারায়ন এর জীবন এ অভাব ও কম ছিল না। রাজনারায়ণ এর অভাব ছিল একটা অবলম্বনের। যে অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে সে জীবনের সকল রস আস্বাদন করতে চেয়েছিল সে তো কবেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর রঞ্জাবতীর জীবনে যে অভাব তা পৃথিবীর কোনো সুখই সেই অভাব এর ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম নয়।এই ধ্রুব সত্যটা রাজনারায়ন খুব মন থেকে বিশ্বাস করতেন । রঞ্জাবতী কে জন্ম দিতে গিয়ে রাজ নারায়ণের স্ত্রী যখন মারা যান রাজনারায়ণ মানসিকভাবে তখন খুবই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন ।একরত্তি রঞ্জাবতী কে সে কিভাবে বাঁচবে এই চিন্তা তাকে ব্যাকুল করে তুলেছিল। তাছাড়া আকস্মিক পত্নি বিয়োগে তখন তার অবস্থা প্রায় বদ্ধ উন্মাদের মতো। এই সময়ে রাজ নারায়নের শালিকা তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ।তিনিই রঞ্জাবতী কে তিন বছর কোলে পিঠে মানুষ করেছেন। রাজনারায়ণ সেই সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা শেষে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে দশ কিলোমিটার গিয়ে সেখান থেকে শিশু রঞ্জাবতী কে দেখে আসতেন। কখনো কখনো রাত হয়ে গেলে সেখানে থেকেও যেতেন। তাতে অবশ্য রঞ্জাবতীর মেসোর কোন আপত্তি ছিল না। বরঞ্চ রাজনারায়ণ কে রঞ্জাবতীর মেসো বারীন বাবু বোঝাতেন রঞ্জাবতী একটু বড় হয়ে গেলেই ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো। এই একরত্তি রঞ্জাবতী কে নিয়েই শুরু হবে তোমার নতুন জীবন। তোমার নিঃসঙ্গ জীবনে আসবে অফুরন্ত সুখ। বাবা মেয়ে একে অন্যকে অবলম্বন করে তখন সংসার পাতবেন। কিন্তু কখনোই রঞ্জাবতীর নতুন মা আনার কথা মাথাতে আনবেন না। এতে হয়তো আপনার জীবনে যতটুকু সুখ অবশিষ্ট আছে, সেটুকুও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রাজনারায়ণ কথা রেখেছিলেন বারিন বাবুর। রঞ্জাবতী কে নিজের কাছে রেখে সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন তাকে আদর যত্নে বড়ো করে তুলতে।
বছর তিনেক মাসি স্নেহের ছায়ায় থাকার পর রঞ্জাবতী ফিরে আসে তার বাবার কাছে। শুরু হয় বাবা মেয়ের একে অন্যের পরিপূরক একটি সংসার। রঞ্জাবতী যে স্বভাব এ খুবই শান্ত ছিল তা বলা যায় না। তবে তার দস্সিপনাও মাত্রাতিরিক্ত ছিল না। রঞ্জাবতী দের বাড়ির পাশেই বাড়ি কাননের সাথে ছিল তার গভীর বন্ধুত্ব। তারা ছিল সমবয়সী। একই স্কুলে ও একই শ্রেণীতে পড়াশোনা করতো। সুতরাং উভয়ের ই উভয়ের বাড়ি যাতায়াত ছিল অগাধ। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, ক্লান্ত অপরাহ্ণে পাত্র দের বাগান থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়া, কখনো কখনো ঘুরে ঘুরে মাঠে শাকতলা এই সকল কাজেরই সঙ্গী ছিল কানন।
কাননের বাবা ছিলেন পেশায় একজন গ্রামীণ পিয়ন। কানন রা ছিল পাচ বোন দুই ভাই। তাদের মধ্যে কানন ই ছিল বয়স এ জ্যেষ্ঠ। সুতরাং অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পরই কাননের দেখাশোনার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল । দুই সখির ছাড়াছাড়ি দিনও একসময় ঘনিয়ে এলো। কানন আরো পড়াশোনা করতে চাইলেও সেই রূপ কোন ইচ্ছা প্রকাশ্যে তার বাড়ির লোকজনের কাছে প্রকাশ করতে পারেনি সে। কারণ কাননের পর আরও চার বোন দুই ভাই আছে । তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার এই ভবিতব্য মেনে নেওয়াটাই হয়ত ছিল তার কাছে অধিক বুদ্ধিমানের কাজ । কিন্তু তার প্রাণের অধিক প্রিয় রঞ্জাবতীর কাছে তার ইচ্ছা গোপন রাখতে পারেনি। কোনো এক শীতের মিষ্টি রোদেলা আলোয় রঞ্জাবতী ও কানন তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের নানা ঘটনায় নিজেদের মাতিয়ে রেখেছিল। সেদিনই কানন বলেছিল রঞ্জাবতী কে-- আমার তো আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। কিন্তু রঞ্জা তুই যেন পড়াশুনাটার সাথে নিজেকে কোনদিন আপোষ করিস না। আমার মতো তোর তো কোনো পারিবারিক সমস্যা নেই। বরঞ্চ তোর বাবা স্কুলের শিক্ষক । তাঁর নিশ্চয়ই তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আছে। তা পুরন করিস ।
দেখতে দেখতে মাঘ মাসের কন কনে ঠান্ডায় কাননের বিয়ে হয়ে গেল। সে চলে গেল শশুরালয়ে। কানোনকে হারিয়ে রঞ্জাবতীর নিজেকে আরো একা মনে হতে লাগলো। কিন্তু কাননের কথাগুলো তার কানে সর্বদাই বাজতে থাকে। তার মনে গেথে গেল। রঞ্জাবতী ও চায় নিজেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। রাজনারায়ণ যেহেতু পেশায় শিক্ষক তিনিও বরাবর চেয়েছেন নিজের একমাত্র আশার আলোকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে। কিন্তু রাজ নারায়নের সেই আশার আলো প্রায় নিভতে বসেছিল। রঞ্জাবতী সেবছর নবম শ্রেণীতে উঠলো ওদিকে রাজনারায়ন এর শরীরে অজানা এক রোগ বাসা বাঁধলো। গ্রামের বহু ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়েও শরীর আগের মত আর হলো না। রঞ্জাবতীও লক্ষ্য করল রাজনারায়ন শরীরের দ্রুত অবনতি। শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ল যে রাজনারায়ণ আর সাইকেলে চেপে বিদ্যালয়ে যেতে পারতে না। রঞ্জাবতীই সাইকেলে করে বিদ্যালয় নিয়ে যেত তাঁকে এবং স্কুল শেষে একসাথে বাড়ি ফিরত বাবা কে নিয়ে। শরীরের এই অবস্থা দিন দিন আরো শোচনীয় হয়ে পড়লো। এমন সময়ে রঞ্জাবতীর বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের পিসি মালতি ও লক্ষণ কাকা দুজনে মিলে রাজনারায়ণ কে বোঝালেন যত শীঘ্রই সম্ভব রঞ্জাবতী কে সৎ পাত্রের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। কারণ রাজনারায়নের অবর্তমানে রঞ্জাবতীর জীবনে অনিশ্চয়তা প্রবল।ও দিকে রঞ্জাবতীর মাসির ও অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। কারণ বারিন বাবুর ব্রেন স্ট্রোক হয়ে মারা যাওয়ার পর রঞ্জাবতীর মাসি ও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সকল কথা চিন্তা করে রাজনারায়ণ তার কন্যা রঞ্জাবতীর বিবাহের জন্য পাত্র দেখার অনুরোধ করেন ঘটক মশাই কে। সেইমতো কলকাতা নিবাসী কিশোরী লালের সাথে বিবাহ ঠিক হয়। যথা সময়ে বয়সে রঞ্জাবতীর থেকে বেশ খানিকটা বড় হলেও রঞ্জাবতীর অনুমতি নিয়েই বিয়ে দেন রাজনারায়ন।
চলবে....
ছবি : নিজস্ব
0 মন্তব্যসমূহ