রঞ্জাবতী ( পারিবারিক গল্প) ষষ্ঠ পর্ব
রঞ্জাবতী চলল নতুন জীবনের ঠিকানায়। এই প্রথম সে বাবাকে ছাড়া ঘর ছাড়লো। যদিও রঞ্জাবতী বাড়ি থেকে খুব একটা বেড়তো না। আসলে তাদের তেমন কোনো নিকটাত্মীয় ছিল না । তাই স্বাভাবিকভাবেই এদিক-ওদিক যাতায়াতও ছিল কম। মাসির বাড়ি গেলেও বাবার সাথেই সে যেত। গত কাল থেকে ইরাবতীর সাথে তার পরিচয় ঘটলেও কিশোরীলাল এর সাথে তার কোন কথাই হয়নি। তবে মাঝে মাঝেই কিশোরীলাল এর চোখে চোখ পড়তেই যেন রঞ্জাবতীর মনে হচ্ছিল সে তাকে কিছু বলতে চায়। আর এই চোখাচোখি হওয়ার ব্যাপারটা বারবারই হতে থাক ছিল। ইরাবতীর তা দৃষ্টি এড়াল না। গাড়ির মধ্যেই ইরাবতী বলল-- দাদা ভাই তোমার যদি কিছু বলার থাকে বৌমনিকে বলতে পারো। উত্তরে কিশোরীলাল খানিক ইতস্তত করে বলল না! তেমন কিছুই বলার নেই। ও কে তুই জিজ্ঞাসা করে নে গাড়িতে যেতে ওর কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো? না মানে অনেকেরই তো গাড়িতে উঠলে মাথা ঘোরে, গা গুলোয়। তাই বলছি। তাহলে গাড়ীর জানালা গুলো আরো একটু খুলে দিতাম। রঞ্জাবতী ঘাড় নেড়ে শাড়ির আঁচল এর একটি কোন ধরে নীচু কন্ঠে বলল--- না না আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না।
গ্রামের কাঁচা রাস্তা শেষ করে গাড়ী চলল পাকা রাস্তার উপর দিয়ে। দু'ধারে একটি-দুটি ঘুমটি, চা, সিগারেটের দোকান, আনাজের দোকান, ফলের দোকান, সেলুন সমস্ত কিছুকে পিছনে ফেলে গ্রাম পেরিয়ে মফস্বল , মফস্বল পেরিয়ে কিছু ঘন্টা পর কলকাতার রাস্তায় উঠলো গাড়ি।
ব্যস্ত পিচ রাস্তা কে আকড়ে লোকজনের কোলাহল, গাড়ি-ঘোড়ার তীব্র প্রকট আওয়াজ এইসব কান্ডকারখানা রঞ্জাবতী এই প্রথম দেখল। এই প্রথম কলকাতার সাথে তার পরিচয়। সে হা করে গাড়ির জানালা দিয়ে সেইসব দৃশ্য দেখতে থাকলো। তখনকার তিলোত্তমা এখনকার মতো এতটা ব্যস্ত না থাকলেও সদ্য গ্রাম থেকে আগত কোন কিশোরী মনের কাছে ছিল তা যথেষ্ট কোলাহলপূর্ণ। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি এসে দাঁড়াল এক বিশাল আকার গেটের সামনে। এতক্ষন রঞ্জাবতী বিভোর হয়ে হয়ে শহরের রূপ দেখতেই মত্ত ছিল। গাড়ি থামার শব্দে তার ঘোর কাটে। ইরাবতী রঞ্জাবতীর হাতে হাত রেখে আস্তে করে তার কানের কাছে মুখ দিয়ে বলে --বউমণি আমরা বাড়ি চলে এসেছি।
গাড়ির হর্নের শব্দে বাড়ি থেকে আমন্ত্রিতরা বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। এত বড় গেট রঞ্জাবতী আগে কখনো দেখেনি ।তাদের স্কুলের গেটটার থেকেও এই গেট টা অনেকটা বড়। গাড়িতে থাকাকালীনই বয়োজ্যেষ্ঠ রা কিশোরিলাল ও রঞ্জাবতী কে জল, সন্দেশ খাওয়ালেন।এরপর কিশোরিলাল নামলো গাড়ি থেকে। ইরাবতীর হাত ধরে এই রঞ্জা কলকাতার মাটিতে তথা নিজের বাড়িতে পা রাখলো। গেট পার হতেই দুধারে নাম না জানা হরেক ফুলের বাহার।তার মাঝখান দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করার রাস্তা। সেই রাস্তা পুরোটাই লাল কার্পেট দিয়ে মোড়া। দু'ধারে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা ফুলের পাপড়ি ছুড়ে স্বাগত জানাচ্ছে রঞ্জাবতীদের। ভেসে আসছে সানাই এর সুর।
এতক্ষন গাড়িতে থাকা কালীন রঞ্জার এতটা ভয় করেনি। সে তো বিভোর হয়ে তিলোত্তমার রূপ দেখতেই ব্যাস্ত ছিল। আর এখন সম্পূর্ণ অচেনা একটি জায়গায় জনসমাগমের আগমন দেখে সে ভ্যাবাচাকা হয়ে গেল। বাড়ির দরজার সামনে এসে পৌঁছাতেই তারকনাথ বাবু বললেন -- আমার রানি মা এসে গেছে। ওহে... কে কোথায় আছো? সকলে উলু দাও। ও... গিন্নি তাড়াতাড়ি
বরণ করো। দেখো দেখি আমার রানি মায়ের মুখ খানা কেমন শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে।
রঞ্জার মনে পড়ে গেল তার শ্বশুর মশাই দেখাশোনায় এসেই তার নাম দিয়েছিলেন রানি। রঞ্জা থেকে রানি।
--আরে দাঁড়াও ,দাঁড়াও! তাড়াতাড়ি বললেই কি হয়ে যাবে নাকি ! আমার একমাত্র কিশোরীর বিয়ে বলে কথা ...আমি বৌমাকে প্রাণভরে বরণ করব , আশীর্বাদ করব ।সমস্ত আচার কানুন নিখুঁত ভাবে পালন করবো।তারপর ঘরে নিয়ে আসবো।
--- মা , বউমণিকে তো আগে আমাদের মন্দিরে নিয়ে যেতে হবে । আগেই ঘরে নিয়ে যাবে বললে যে?
রঞ্জার মেজ ননদ প্রিয়বতীর কথায় রঞ্জার শাশুড়ি মা এক হাত জিভ কেটে বললেন-- ঠিক বলেছিস, কত বড় ভুলটাই না করছিলাম !
--- এসো বৌমা, আমায় অনুসরণ করে এসো। এই হলো আমাদের বাড়ির ঠাকুর মন্দির । এখানে বারোমাসই সকল ঠাকুর পূজিত হয়। দুর্গা ঠাকুর ও পুজো হয়। প্রণাম করো। মাথা নিচু করে উপুড় হয়ে সে ঠাকুর প্রণাম করল। আর মনে মনে বলল-- সকল তেত্রিশ কোটি দেব দেবী কে আমার প্রণাম। আমি নতুন জীবনে পা দিয়েছি ভগবান । যেন সকলকে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারি। ঠাকুর আমি যেন সকলের ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হই। আমায় শক্তি দিও প্রভু , ধৈর্য দিও । আর আমার বাবাকে ভালো রেখো প্রভু । বলেই উপুর হয়েই কাঁদতে থাকলো রঞ্জা।
সুলচনা দেবী অর্থাৎ রঞ্জার শাশুড়ি মা রঞ্জা কে চোখের জল মুছিয়ে নিজের বুকে টেনে নিলেন। রঞ্জার কপালে চুমু এঁকে তাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। আর কিশোরিলালকে বললেন -- তুমিও মন্দিরে প্রণাম করে তবেই এসো। আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
প্রণাম সেরে কিশোরীলাল আসতেই রঞ্জা দেখল সামনে দুধে আলতার থালা রাখা। রঞ্জার বড়ো ননদ রূপবতী তাকে বললেন -- " বউমণি তুমি এই আলতা জলে তোমার পা দুটো সাবধানে রাখো । দেখো পড়ে যেও না যেন।
--- ওরে, ইরা... বৌমনির হাতটা একটু ধরে সাহায্য কর।
--হ্যাঁ বাবা ধরছি।
--- বউ মনি এবার বা পা টা আগে বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ঘরে চলো।
ঘরে প্রবেশ করার পরই কড়ি খেলা হলো,এক গামলা দুধে-আলতা জলের মধ্যে আংটি খোঁজা খেলা হল। দুটি খেলাতেই যেন ইচ্ছে করেই কিশোরী লাল রঞ্জা কে জিতিয়ে দিলো । আংটি খোঁজার সময় বারবারই কিশোরিলাল এর আঙুলের স্পর্শ রঞ্জার আঙ্গুল স্পর্শ করছিল। তখন দুটি প্রানের মধ্যেই এক অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছিল । কিন্তু তারকবাবুর নির্দেশে সেইসব খেলার পাঠ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হলো।
রঞ্জার জন্য ঘরেই খাবার নিয়ে আসা হলো। কিন্তু তখন তার খিদে থাকলেও খেতে মন চাইছিল না । রঞ্জার শাশুড়ি মা নিজে হাতে তাকে খাইয়ে দিলেন। জীবনে এই প্রথম সে মায়ের হাতে খাবার খাচ্ছে। এত খুশিতে রঞ্জা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।সে কান্না যেন থামতেই চায় না। তার এইরূপ কান্না দেখে সুলোচনা দেবীও চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। ---আমি জানি মা, তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। তোর কষ্টটা আমি বুঝি। আমি তো আছি । তোর কাছে সব সময়। এখানকার সব কিছুর সঙ্গে তোর মানিয়ে নিতে একটু দেরি হবে। কিন্তু দেখে নিস সকলেই তোকে ভালবাসবে, আপন করে নেবে। আর আমার কিশোরী বড়ো ভাল ছেলে। কথা একটু কম বলে। তবে আমার নিজের ছেলে বলে বলছি না-- ও খুবই দায়িত্ববান। আজ সন্ধ্যেবেলা তেই তো ও বাড়ি থেকে তোর বাবা , আত্মীয়রা আসবেন।তারা যদি দেখে তুই কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিস তাদের কষ্ট হবে না বল ?তাই বলছি চোখের জল মোছ মা। আরেকটু খেয়ে নে। আমি ইরাকে ডেকে দিচ্ছি। ও তোকে স্নানের ঘর দেখিয়ে দেবে। তারপর স্নান করে একটু বিশ্রাম নিবি। এরপর ইরা ও রঞ্জা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে শুয়ে দুটো একটা কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙল প্রিয়বতী ও রূপবতীর হাকাহাকিতে।
এই ইরা, দরজা খোল। আর কতক্ষন ঘুমাবি রে তুই ? বউমণিকে এবার সাজাতে হবে তো ? বেলা গড়িয়ে যে বিকেল হয়ে গেলো।আর একটু পরেই তো আমন্ত্রিত রা সবাই এসে যাবে। বউমণিকে দেখতে চাইবে।
তাদের চিৎকার এ রঞ্জা ধড়মড় করে উঠে বসে । ইরা তখন ও ঘুমিয়ে চলেছে ।রঞ্জা ঘুমন্ত ইরাকে কিভাবে ডাকবে ঠেলা দিয়ে না কি নাম ধরে ডেকে তা বুঝতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে সে ইরার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল--বোন , উঠে পরো। বাইরে সকলে ডাকছেন। আমি দরজা খুলছি।
রঞ্জার হাতের স্পর্শে ও নরম কণ্ঠস্বরে চোখ খুলে তাকালো ইরা। দুই হাত দিয়ে চোখ রোগড়ে নিয়ে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল--
---ইস স! কত টা বেলা হয়ে গেছে। সত্যিই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। কেন যে দায়িত্ব জ্ঞানহীন হয়ে এতক্ষণ পরে পরে ঘুমালাম বলতে বলতে সে উঠে বসলো। ততক্ষনে ইরাবতী দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়েছে।আর তার নিজের ননদ, মাসতুতো, পিসতুতো আমন্ত্রিত আরো ননদ গুলো তখন ঘরে এসে ভিড় করেছে
। তাদের মধ্যে থেকে কোন এক পিসতুতো ননদ বলে উঠলো
--- এই ইরা, তুই কি সর্বক্ষণ এঁটুলি পোকার মতো তোর বউ মনি সাথে এঁটে থাকবি না কি রে ? সেই তো কাল থেকে বেচারা মেয়েটাকে বিরক্ত করে যাচ্ছিস।
চলবে....
ছবি : সংগৃহীত
1 মন্তব্যসমূহ
7C3D1DB0F0
উত্তরমুছুনkiralık hacker
hacker arıyorum
kiralık hacker
hacker arıyorum
belek