রঞ্জাবতী ( পারিবারিক গল্প) দশম পর্ব
চোখের জল মুছে রঞ্জা বলে, হ্যাঁ এটাই গো ড্রাইভার দাদা । গাড়ির দরজা খুলে রঞ্জা ছুটে গিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। গাড়ির আওয়াজ শোনা মাত্রই রাজনারায়নবাবুও বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন। বাবাকে দেখে রঞ্জা জড়িয়ে ধরল।
--বাবা, তুমি কেমন আছো? কতটা রোগা হয়ে গেছো। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করছ না তাইতো ? ওষুধগুলো ঠিকমতো খাচ্ছ?আমার তো মনে হচ্ছে খাচ্ছ না। তাহলে এতটা দুর্বল তোমায় লাগত না ।
কই ? কই? মালতি পিসি কই? তাকে আমি জিজ্ঞাসা করবো । তুমি আমায় সত্যি কথা বলবে না। এ আমি নিশ্চিত।
---ওরে, তুই যে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলে এলি। তা, বাবাজীবন কোথায়? তাকে নিয়ে আসি আগে।
ততক্ষণে কিশোরীও এসে উপস্থিত হয়েছে । রঞ্জার এইরূপ গিন্নিপনা দেখে তারো বেশ লাগছিল।
মালতি পিসি এসে কিশোরীকে ঘরে নিয়ে গেলেন । জল খাবার খেতে দিয়ে মালতিই কিশোরীকে বললেন--- দাদা মানে, রঞ্জার বাবার শরীরটা সত্যিই খুব একটা ভালো না । সারাটা দিন ঝিমিয়ে মনমরা হয়ে থাকেন। সব কিছু শুনে কিশোরী মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় রাজনারায়ন বাবুকে তিনি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাবেন।
বেলার দিকে মালতী পিসির সাথে রঞ্জা বেড়াতে বেরুলে কিশোরী রাজনারায়নবাবুর ঘরে ঢোকে।
--- আপনার সাথে কিছু জরুরী আলোচনা ছিল বাবা। আপনি কি ব্যস্ত আছেন ।
---না, না। এসো বাবাজীবন বসো।
---আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনার শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। আমি ঠিক করেছি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে আপনার চিকিৎসা করাব।
--- না, না তা হয় না । আমি তো ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছি ই। ডাক্তার বলে দিয়েছেন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিশোরী কোন কথাই শুনলো না। শেষ পর্যন্ত কিশোরীর জেদের কাছে হার মানল রাজনারায়ণ বাবু। ঠিক হলো রঞ্জারা আজই নিয়ম অনুযায়ী বৈকালে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। এবং আগামীকালই কলকাতা থেকে গাড়ি এসে রাজনারায়ণবাবু কে নিয়ে যাবে।
সুতরাং অষ্টমঙ্গলা সেরে সেদিনই রঞ্জা আর কিশোরী ফিরে এলো কলকাতায়। আসামাত্রই কিশোরী অন্দরমহলে তারকনাথ বাবুর খোঁজ করলেন। তাঁর সাথে আলোচনা করে পরের দিন ভোরেই তারকনাথ বাবু গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেন সরিষাপুর এর উদ্দেশ্যে।
কোলকাতায় ভাল ডাক্তার দেখানোর বন্দোবস্ত হলো। কিন্তু সমস্ত রকম শারীরিক পরীক্ষা করা সত্বেও তার কোনো শরীরের সমস্যাই ধরা পড়ছিল না। অবশেষে শহরের নামকরা ডাক্তার রথীন চাটুজ্জের পরামর্শে মানসিক ডাক্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সেইমতো চিকিৎসা এগোতে থাকে। মানসিক ডাক্তার ডক্টর অমল সেন রাজনারায়ণ বাবুর সাথে কথা বলে বুঝতে পারেন তার শারীরিক সমস্যার তৈরি হয়েছে মানসিক চিন্তা থেকেই। অত্যাধিক চিন্তার কারণেই তার শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা , হাত, পা কাপা এই ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। রঞ্জাবতী কে নিয়ে তিনি আগাগোড়াই চিন্তা করতেন। তাই তার বয়স যত এগোচ্ছিল তার জন্য চিন্তা ও অধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল । ফলে তাঁর শরীরের নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছিল। অনেক ডাক্তারই এই রোগ টির প্রকৃত কারণ বুঝতে না পারায় শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা, কেউ বা মাইগ্রেনের সমস্যা ভেবে তার চিকিৎসা চালাচ্ছিলেন। রঞ্জাবতী ভালো বাড়িতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছে এ ছিল তার কাছে চরম সৌভাগ্যের। খুশিতে তার মনের উপর চাপ কম ছিলো । সজ্জন পরিবারে আত্মীয়তায় তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতিও হয়েছিল। কিন্তু একমাত্র অবলম্বন রঞ্জা কে ছেড়ে তিনি বড় বেশি একা হয়ে পড়েন। আবার শরীরের অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
তাই ডক্টর অমল সেনের সাথে পরামর্শ করে তারকনাথ বাবু সিদ্ধান্ত নেন রাজনারায়ন বাবুকে বরাবরের জন্যই এখানে রেখে দেবেন । এই সিদ্ধান্তে রঞ্জা খুব খুশি হয়। তারক নাথ বাবুর এই সিদ্ধান্তে ও রঞ্জার খুশিতে কিশোরীলালও মনে শান্তি পায়।
কিন্তু রাজনারায়ণ বাবুর এতে ছিল ঘোর আপত্তি। মেয়ের বাড়িতে বোঝা হয়ে থাকতে তিনি চাইছিলেন না। আসলে ব্যাপারটা ঠিক বোঝা নয়। তাদের সুখের সংসারে তার উপস্থিতিতে শান্তির ব্যাঘাত ঘটে তা তিনি চাননি । কিন্তু শেষমেষ তারক নাথ বাবু ও সুলোচনা দেবীর অনুরোধে থাকতে বাধ্য হন। এবং স্কুল থেকেও ভলেন্টিয়ার রিটায়ার্ড নিতে হয়।
মালতি ও লক্ষণ এর ওপর সরিষা পুরের বাড়ি ও জমি জায়গার দেখাশোনা দায়িত্ব দিয়ে রাজনারায়ন বরাবরের জন্য মেয়ের সংসার চলে আসেন। প্রথম দিকে তার কলকাতায় থাকতে অস্বস্তি বোধ হলেও রঞ্জা ও ইরাকে শিক্ষা দানের মাধ্যমে তিনি মনে পরম তৃপ্তি পেতেন। তাছাড়া রঞ্জা ও ইরার বন্ধুবান্ধবরাও আস্তে শুরু করে রাজনারায়ন বাবুর কাছে পড়াশোনার জন্য। এর ফলে রাজনারায়ন বাবুর আগের মতোই শিক্ষাদানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। রঞ্জাকে ঘিরে যে সকল স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা আস্তে আস্তে বাস্তবায়িত হতে থাকে।
এইদিকে ইরা পরেছে মহা সমস্যায়। সকালের দিকে রঞ্জা ও ইরা একসাথে রাজনারায়ণ বাবুর কাছে পড়ে। এবং সন্ধ্যের দিকে ইন্দ্রজিৎ বাবু আসতেন তাঁদের পড়াতে। ইন্দ্রজিত বাবুই প্রিয়বতী, রুপবতীর গৃহ শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনিই ইরাবতী কে পড়াতেন। কিন্তু পড়াশোনা বাহিরেও যে তাদের মধ্যে অন্য একটি সম্পর্ক আছে তা ইরাবতী বেমালুম চেপে গিয়েছিল রঞ্জার কাছে। ইতিমধ্যে ইরা মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছি। এবং রঞ্জা ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
--- রঞ্জা , সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসার সময় তুমি ইরা কে একটু চোখে চোখে রেখ তো?
--- কেন বলো তো?
--- এ বাবা! তুমি তাও জানোনা ?তোমার প্রানের সখি এই কথাটা এখনো বলেনি?
--- কেন? কি কথা? তুমি বলো আমায়?
---না, আমি তো বলব না।
--- ধুর! আর উত্তেজিত করো না আমায়। দোহাই তোমার , দয়া করে আমায় সব টা খুলে বলো ।
---তবে শোনো, তোমার ওই গুনবতী ননদিনী ইন্দ্রজিতের সাথে গোপনে প্রেম করে। সেটাও বুঝি এতদিন লক্ষ্য করনি।
--- ধ্যাৎ, সত্যি ? আমার তো বিশ্বাসই হয় না ।
---তবে জিজ্ঞাসা করো তোমার ননদিনী কে।
কিশোরী লালের কাছ থেকে একথা শুনা মাত্রই রঞ্জা ছুটে গিয়ে ইরার ঘরে প্রবেশ করে।
---বৌমনি, কি গো এত হন্ত দন্ত হয়ে এলে । কিছু হয়েছে বুঝি?
---এই বুঝি আমি তোমার প্রাণের প্রিয় বউ মনি? যাকে বিশ্বাস করে কোনো কথা বলা যায়না।
--- ওমা আমি আবার কোন কথা তোমার কাছে লুকোলাম। সকাল সকাল কি হল বলো তো তোমার ? আজেবাজে বকছ। শরীর ঠিক আছে তো?
--- হ্যাঁ, আমি ঠিকই আছি। ইন্দ্রজিৎ বাবুর সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক শুনি?
--- কই কিছু নাতো!
--তোমার দাদা আমায় সব বলেছে। আর লজ্জা পেয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে হবে না। তলে তলে তাহলে
এত কিছু?
চলবে.....
( পরবর্তী পর্বই হবে অন্তিম পর্ব)।
সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
সকল কে জানাই শুভ বিজয়া দশমীর আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। গুরুজনদের জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ