রঞ্জাবতী (পারিবারিক গল্প) নবম পর্ব
তারা ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই প্রিয়বতী ঘরের দরজা বন্ধ করে ছিটকিনিটা দিয়ে দিল । রঞ্জা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ।
---আরে, বউ মনি আমাদের আবার ভয় পাচ্ছ কেন? আগে বলো কালকে সোয়াগ রাত তোমাদের কেমন কাটলো ? আমাদের গুরুগম্ভীর রামগরুড়ের ছানা দাদা টা ঠিক ভাবে কথা তথা বলেছে তো? নাকি নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছে? চুপ করে কেন আছো? কিছু তো বলো? আর যে ধৈর্য ধরে রাখতে পারছিনা।
---এই ইরা তোর শখ তো মন্দ না। আমাদের চেয়ে দেখছি তোর আগ্রহ বেশি। আমরা বিবাহিত আমরা জিজ্ঞাসা করতেই পারি। তোকে এসব গল্প শুনতে হবে না । এখন যা। ঘর ছার।
---- ও !! বউমণিকে, ডেকে দেবার বেলায় আমি। আর তোমরা লীলা কীর্তন শুনবে আমায় বাদ দিয়ে তাই না?সেটি তো হচ্ছে না।
বউ মনি, তুমি ওদের কথা বাদ দাও। তুমি আমায় বলতো, ওই হলুদ রঙের খামে ভরা চিঠি টা তোমায় দিয়েছে নাকি ওটাও দিতে লজ্জা পেয়েছে দাদাভাই? হলুদ রঙের খামে মোড়া চিঠির কথাটা শুনে চমকে উঠলো রঞ্জা। মনে মনে ভাবল --- তবে যে উনি বললেন, এই চিঠিখানা কথা যেন আমি কাউকে না বলি, তবে এরা তার খবর পেল কি করে?
রঞ্জা কে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে প্রিয়বতী, রূপবতী, ইরাবতী ঘিরে একসঙ্গে বলল ওই চিঠিতে কি লেখা আছে বউমণির তোমায় বলতেই হবে।
রঞ্জা ভয়ে ভয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো কিন্তু ওই চিঠির কথা তোমরা জানলে কি করে? তবে যে উনি বললেন, এই চিঠিখানা কথা কাউকে বলবে না। তাহলে উনি তো এবার আমায় মিথ্যেবাদী ভাববেন।
কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল আমায় অ বিশ্বাসও করবে।
--- আ...রে! এই দেখ দেখি কাঁদছো কেন? দাদা ভাই অমন কথা হামেশাই বলে। ওর কথা বাদ দাও তো। খামোখা ওকে নিয়ে এত চিন্তা করো না। ওই চিঠি খানের কথা কেই বা জানে না । সকলেই চিঠিখানা দাদা ভাইয়ের হাতে দেখেছে। আমরা সবাই দেখেছি সন্ধ্যেবেলায় ওই দাদাভাই এর ঘরের সামনে লাগোয়া ঝুল বারান্দা টায় দাঁড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে দাদাকে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। তবে ওই চিঠিতে কি লেখা আছে সেটা তো জানি না । আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে এটা তোমার উদ্দেশ্যেই লেখা। তাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি ।
হঠাৎ দরজায় দমদম আওয়াজে তারা চুপ করে যায়। ততক্ষণ এ চোখের জল মুছে রঞ্জা ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে হাতের তালু ঘুরিয়ে ইশারায় ভ্রু তুলে বলছে বাইরে কে হতে পারে। ইরা গলার স্বর নামিয়ে নিচু স্বরে বললো দাড়াও আমি দেখছি। সে পা টিপে টিপে দরজার কাছে যেতেই শুনতে পেলো ---আরে, আমি! দরজাটা খোল। সুলোচনা দেবীর গলায় সকলের ধরে যেন প্রাণ এলো।
ইরাবতী দরজাটা খুলে দিল।
--- এতোক্ষণ সময় লাগলো দরজাটা খুলতে?
শাশুড়ি মা এর আগমনে রঞ্জা একটু আড়ষ্ট হয়ে কুঁকড়ে রইলো।
---বৌমা একটা কথা মনে রেখো আমি কেবল মায়ের মতো নয়। আমার তিন মেয়ের যেমন সত্যিকারের মা। তেমনই আমার এখন চার মেয়ে। তোমারও মা আমি । সুলোচনা দেবীর চোখের দিকে চোখ মেলে দেখল রঞ্জা। সে চোখে শুধুই করুনাময়ী মায়ের স্নেহ, আর মায়া। রঞ্জা অপলক দৃষ্টিতে সুলোচনা দেবীর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। হঠাৎই সুলোচনা দেবীর মুখের আদলটা বদলে গিয়ে তার মায়ের মুখটা সে দেখতে পায়।
--- মা !!
বলে জড়িয়ে ধরে সুলোচনা দেবী কে। রঞ্জা কে বুকের মাঝে আকড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন সুলোচনা দেবী।
এই দৃশ্য দেখে কিশোরীর তিন বোন ই খুশি হলো।
--- ও...মা, তোমাদের মা মেয়ের রং ঢং অনেক হয়েছে, তুমি হুট করে চলে আসায় আমাদের আসল কথাটাই শোনা হলো না।
--- আরে সেটা তো জানতেই আমিও এসেছিলাম।
--- তুমি! তুমি কি করে জানলে আমরা এই ঘরে আছি ? আশাই তো বলল ইরা তার বউমণিকে টানতে টানতে ওদিক পানে গেছে।
আমিও কিন্তু জানতে চাই বউ মা, ওই চিঠিতে কিশোরী কি এমন লিখেছে।
-- তুমি পারোও মা। তোমার লজ্জা করে না?
--- দেখ আমার কিশোরী বরাবরই গুরু গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে। সে কিনা আস্ত এক খান প্রেম পত্র লিখেছে। যখনই এ যাবত ওর ঘরের দিকে কোন দরকারে যেতাম তখনই দেখতাম ওই চিঠিখানা নিয়ে বসে থাকতে কিশোরীকে। অ মন রামগরুড়ের ছানার মনেও যে প্রেম আসতে পারে এ তো আমার কল্পনারও অতীত। তাই কৌতুহল বশত আর কি...
---কিন্তু ওই চিঠি তো আমার এখন ও পড়াই হয় নি।
এ কথাটা বলতেই সকলেই হতাশ হয়ে পড়ল । যেন হাওয়া ভর্তি বেলুন গুলো এক নিমিষে সব হাওয়া বেরিয়ে চুপসে গেল । তবে রঞ্জা তাদের বলল চিঠি পড়া হয়ে গেলে সে নিশ্চই তাদের জানাবে।
অষ্টমঙ্গলা দিন সকাল বেলাতেই রঞ্জা বেনারসী পরে সেজেগুজে তৈরি হয়ে নিল। কিশোরীকেও লালচে মেরুন ও ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি পাজামায় বেশ সুদর্শন লাগছিলো।
যেন অনেক অনেক গুলো বছর পর রঞ্জা আবার সরিষাপুরের মাটি স্পর্শ করবে। উত্তেজনায় সে মেয়েবেলার মতো আচরণ শুরু করলো। কিশরীকে বারবার তাড়া দিতে লাগল । বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এ ঘর ওঘর করতে থাকলো। গাড়িতে উঠার সময় ইরার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এতদিনে ইরার দিদিরাও শশুর ঘরে চলে গেছে। রঞ্জা কে ছেড়ে থাকতে ইরার একটুও মন চাইছিল না। ওদের সাথে ওর ও যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও যে উপায় নেই। অষ্টমঙ্গলায় যে কেবল স্বামী স্ত্রীকে জোড়ে যেতে হয়।
চলন্ত গাড়ি টার মতোই যেন দুরন্ত, চঞ্চল এই রঞ্জা। তার চরিত্রের এই রকম রূপ এই প্রথম দেখছে কিশোরী। স্বল্পভাষিণী রঞ্জার মুখে এখন কথার খই ফুটছে।
অনেকদিন পর নিজের গ্রামে যাচ্ছি, নিজের বাড়ি যাচ্ছি , কতদিন পর বাবাকে দেখতে পাব, আমার কী আনন্দ হচ্ছে তা তোমায় বলে বোঝাতে পারবোনা। ড্রাইভারকে একটু জিজ্ঞাসা করো তো আর কতক্ষণ লাগবে?
--- তুমি এত উতলা হয়ো না । আমি তো দেখছি তুমি ইরার চেয়েও বড় বেশি অশান্ত।
মন এত চঞ্চল হলে কি করে পড়াশোনায় মন দেবে শুনি? এবার উঁচু ক্লাসে ভর্তি হতে হবে। সুতরাং একদম ঢিলেমি দিলে চলবে না। সরিষা পুর থেকে ঘুরে এসে পুরোপুরি পড়াশোনায় ডুবে থাকতে হবে তোমায় । আর হ্যাঁ, আমার চিঠিখানা তুমি পড়েছিলে নাকি তোমার এখনো সময় হয়নি।
চিঠির প্রসঙ্গ উঠতেই রঞ্জা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। তার সর্ব অঙ্গ কে যেন লজ্জা গ্রাস করল । কিশোরীর দিকে অল্প তাকিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে সে বলল হ্যাঁ, পড়েছি।
কিশোরীও খানিকটা লজ্জা পেল ।
তখুনি রঞ্জার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল--- আমি আর ইরা দুজনে মিলে দুপুর বেলা বসে ঝাল টক আম বাটা খেতে খেতে ওই পত্রখানি পড়লাম।
উত্তেজিত হয়ে কিশোরী বললো--- তোমায় না বলেছি ও চিঠি কারো সামনে পড়বে না। ইরার সামনে তো মোটেই না। তুমি দেখছি আমার মান-সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিলে। নিজের ব্যক্তিত্ব বলে ওই বাড়িতে আমার আর কিছু রইল না। রঞ্জার উপর ঈষৎ রাগ দেখিয়ে কিশোরীও ও জানালা পথে বাইরের দৃশ্যে মনোনিবেশ করল।
রঞ্জা খানিকটা সরে এসে নিজের কোমল হাত খানি কিশোরীর হাতের উপর রাখল। এই প্রথমবার সে নিজে থেকে কিশোরীর এত কাছাকাছি এলো । মন থেকে ভালো লাগলেও রাগ বশত কিশোরী রঞ্জার হাতটি সরিয়ে দিলো।
--- তোমার কৃষ্ণকলির উপর তুমি এখনো বুঝি রাগ দেখিয়ে যাবে?
রঞ্জার মুখে কৃষ্ণকলি নামটা শুনে মুখটা ফিরিয়ে রঞ্জার দিকে তাকিয়ে বলল--- তুমি তাহলে সত্যিই পড়েছ আমার দেওয়া চিঠি খানা?
---হমম।
আমি ই তোমার কৃষ্ণকলি। আমার একখান মাত্র ছবি পেয়ে আমার প্রতি এত গভীর পবিত্র ভালোবাসা তোমার মনে সৃষ্টি হয়েছে। এ যে আমার পরম প্রাপ্তি।
কিন্তু আমি অত্যন্ত দুঃখিত ওই চিঠির কথা আমার আগেই বাড়ির সবাই জানত। ইরা এমনকি মা ও তোমায় অনেক বারই চিঠিখানা নিয়ে উদাস হয়ে বসে থাকতে দেখে ছিলেন। তাই এই চিঠির লেখাগুলো আমি ওদের বলতে বাধ্য হয়েছি।
--- আচ্ছা, বেশ তা আমার লেখা চিঠি পড়ে তোমার ঐ পেকো সখি দাঁত বার করে পেত্নীর মত হাসছিল বুঝি তাই তো? না, ইরা হাসেনি। তবে মা একটু মুচকে হেসে ছিল।
--- রঞ্জা তোমার কি বোধ বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে? সর্বনাশ ! তুমি এই চিঠিখানা মাকেও পড়ে শুনিয়েছ। ছি ছি! মান-সম্মান আর কিছুই রইল না দেখছি।
---মা কি ঠাট্টা করে হেসেছিলেন নাকি। একটা পুরুষ মানুষ নারীর শরীরটাকে পিছনে রেখে কিভাবে অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছে তার স্ত্রীকে তা জেনে যেকোনো মা ই যে কারো বোন ই গর্ব করবে তার ছেলে কে নিয়ে। তার দাদাভাই কে নিয়ে। মা হেসেছিলেন কারণ তাঁর ছেলে তার বৌমাকে বৌমা কে কত টা অন্তর দিয়ে ভালোবাসে তা জেনে।
তোমার লেখা চিঠি খানি আমার পুরো ঠোটস্থ । আমি তোমায় বলি শোনো।
---না, সে চিঠি খানি আমি তোমায় সামনাসামনি বলব রাঞ্জা।
" তোমার ছবিটা দেখামাত্রই সেই গাঁয়ের কৃষ্ণকলির কথাই আমার মনে পড়েছিল। যেন কবিতার কৃষ্ণকলি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ।তোমার কাজল কালো ,দীঘল টানা টানা , হরিণী চোখের মায়াবী আকর্ষণে আমি মুহূর্তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম কল্পনার জগতে। সেদিন তোমার মাথায় কোন ঘোমটা ছিল না। কালো মেঘের মতো কেশে লাল ফিতের অবয়বে তোমায় আরো বেশি মায়াময়ী লাগছিল । এই প্রেম, এই ভালোবাসা তা শুধু মাত্র অন্তরের। তোমার দুই নয়ন পানে তাকিয়েই আমি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি রঞ্জা। তোমার চাউনিতে অসম্ভব এক আকর্ষণ আছে। আমি সেটুকু তেই ডুবে থাকতে চাই। তোমার শরীরকে যখন খুশি ছুঁয়ে আমি অপবিত্র করতে চাই না। আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো ।সে আমার পরম সৌভাগ্য। বিবাহ মানেই মানসিক ও শারীরিক সম্পর্ক এর সম্পূর্ণ ক্ষমতাই স্বামীর থাকে। কিন্তু এ ক্ষমতা আমি তোমায় দিলাম কৃষ্ণকলি। তুমি যেদিন ই ধরা দেবে সেদিনই আমি তোমায় স্পর্শ করব। ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবো। তুমি আমার রঞ্জা। তুমি শুধু আমার কৃষ্ণকলি।"
চিঠির কথাগুলো বলার পর কিশোরী ও রঞ্জা একে অপরের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। রঞ্জার চোখে জলে পরিপূর্ণ। সে চোখ এত টাই জ্বল জ্বল করছিল সেই দৃষ্টি পানে চেয়েই তারা দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাত ধরে বসেছিল।
----দাদা, এই বাড়ি টাই তো বৌমনি র বাড়ি? আচমকাই গাড়ি থামার শব্দে রঞ্জা ও কিশোরীর ঘোর কাটে।
চলবে...
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ