রঞ্জাবতী ( পারিবারিক গল্প) অন্তিম পর্ব

 

ronjaboti paribarik golpo last part


রঞ্জাবতী ( পারিবারিক গল্প) অন্তিম পর্ব

বউমণি,  দোহাই তোমার।  আস্তে কথা বলো। সবাই শুনতে পেয়ে যাবে যে।
--- তা কতদিন ধরে চলছে এসব শুনি?
--- আমি , মানে ....আমরা অনেকদিন ধরেই একে অপরকে ভালবাসি । দাদা ওর বন্ধু হওয়ার সূত্রে ওর  থেকে  কিছু কিছু জেনেছে এ ব্যাপারে। বাড়িতে আর কেউ জানেনা । বউমণি তুমি আমার মাথায় হাত রেখে কথা দাও। এ কথা তুমি কাউকে বলবেনা।
-- আমি তোমার  মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বোন তুমি চাওনা এই ভালোবাসা পরিণয় এ পরিণত হোক?  তুমি চাওনা ইন্দ্রজিৎ দার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে?
জানালা ছাপিয়ে বৃষ্টিস্নাত গাছগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরা বলল
--- সব ভালবাসাই কি চাইলেই পরিণতি পায় বৌমনি? আমাদের সম্পর্কটাও  হয়তো তেমন ই অসমাপ্তই থেকে যাবে।
--- ইসস.... কাঁদছো যে বড়ো...বললেই হবে!  তাহলে আমি আছি কি করতে ? 
---না!  বউ মনি,  এর মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে তুমি কেন অপমানিত হবে?
---- অপমান! কিসের অপমান ?কেউ কাউকে পবিত্রভাবে ভালবাসলে তাতে তো কোন দোষ নেই । আর ইন্দ্রজিৎ দা তো ভালো ছেলে। উচ্চ বংশ। কলেজে শিক্ষকতা করেন। তোমার দাদার বেশ পছন্দের পাত্র। তবে অসুবিধাটা কোথায় শুনি? 
--- কিন্তু একথা যে আমি কোনদিনও মা-বাবাকে বলতে পারব না। ও বাবার বন্ধুর ছেলে।  এই সম্পর্কের কথা জানতে পারলে  বাবার  সাথে ওর বাবার এতদিনের  বন্ধুত্ব চিরতরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 
---তাহলে সেটা তোমাদের আগেই ভাবা উচিত ছিল ।যাক যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে । আমার আদরের ননদিনী ভালোবাসার শোকে দিনের-পর-দিন বালিশে মুখ গুঁজে চোখের জল ফেলবে তা তো আমি সইব না । দেখা যাক কি করতে পারি । 
এই বলে রঞ্জা ঘর থেকে প্রস্থান করলো।
---- ওহ্হঃ  দেখো দিকি, কি  কান্ড!  আরেকটু হলেই তো হোঁচটখেয়ে পরে যেতিস রঞ্জা।  আনমনে এইভাবে কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামে?  এই কি হয়েছে বল তো তোর?
--- মা  , তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। 
----এই সাতসকালে আমার মেলায় কাজ পড়ে আছে।  ইরার স্কুল,  তোর কলেজ রান্নায় দেরি হলে তোদের সময়মতো টিফিন দিতে পারব না । আশা কে দেখি গিয়ে ওর রান্না  কতদূর এগুলো। কলেজ থেকে ফিরে আয়। তারপর  সন্ধ্যেবেলায় শুনবো খন।

 সারাটা দিন রঞ্জার অন্যমনস্ক ভাবেই কাটল। ইচ্ছে না থাকলেও  কলেজ যেতেই হলো।  রঞ্জা মনে মনে ভাবলো , না আগে মাকে বলাটা ঠিক হবে না । সরাসরি বাবাকেই সে বলবে।  কিন্তু বাবার সামনে সরাসরি এই ব্যাপারে কথা বলতেও মনে ইতস্তত বোধ জাগছে। কলেজে ক্লাস চলাকালীনও এইসব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। হঠাৎই রঞ্জার মনে পড়ল এই কলেজেই তো ইন্দ্রজিৎ বাবু পড়ান। তার সাথে এখানেই এই ব্যাপারে কথা বলা যেতে পারে। পরক্ষনেই মনে হলো এটা ব্যক্তিগত আলোচনা করার স্থান নয় ।
কি বলবে,  কাকে বলবে, কিভাবে বলবে, কিছুই মন থেকে  স্থির করতে পারল না সে। ইরার  মুখে তাদের অনুরাগ এর কথা শোনার পর থেকেই রঞ্জা স্থির করে নিয়েছিল এই সমস্যার সমাধান যত শীঘ্রই সম্ভব মেটানো উচিত। 
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে রঞ্জা প্রথম রাজনারায়ন বাবুর ঘরে ঢুকলো । তিনি তখন গল্পের বইয়ে মনোনিবেশ করেছেন। তাই তার উপস্থিতি তিনি প্রথমে টের পেলেন না। টেবিলের ওপর রঞ্জা ব্যাগ খানা রাখা মাত্রই রাজ নারায়ন বাবু চোখ তুলে দেখলেন  রঞ্জাকে। 
---কিরে , কলেজ থেকে এসে পোশাক না বদলে সোজা  এখানে , কি ব্যাপার ?
---বাবা,  তুমি আমায় একটু সাহায্য করতে পারবে?
--- কি হয়েছে সেটা তো বল?
--- ইরাবতীর সাথে ইন্দ্রজিত দা.... মানে  ইন্দ্রজিত দার সাথে....
রঞ্জার  কথা শেষ হওয়ার আগেই রাজনারায়ণ  বাবু  অল্প হেসে বললেন
---- ইন্দ্রজিৎ এর সাথে  ইরাবতীর প্রণয়ের সম্পর্কের কথা বলছিস তো? এ বিষয়ে তারকনাথ  বাবু অনেক আগেই আমার সাথে আলোচনা করেছেন। ইরাবতীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পরই তাদের বিবাহ দেয়া হবে। ইন্দ্রজিতের বাবা মানে আশুতোষ বাবুর  বাড়ি আমি,  তারকনাথ বাবু,  তোর  মা  ও কিশোরী সকলে  এক সঙ্গে গিয়ে কথাবার্তা বলে এসেছি। সে  মাস ছয়েক আগে। 
রাজনারায়ন বাবুর মুখে  একথা শুনে রঞ্জা সম্ভীত হয়ে যায়।বাবার উপর রাগ দেখিয়ে বলে
--- তোমরা কেউ এ কথা আমায় জানাও নি কেন? 
----ওরে, ইরা আর তুই যে  হরিহর আত্মা। তুই জানলে যে ওকে বলে দিতিস। তাহলে ওর কি আর পড়াশোনায় মন বসবে। কিশোরীই তোকে না বলার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরাই কি  ইরাবতীর মনের খবর জানতাম।  বাবা জীবনই তো ইন্দ্রজিৎ এর থেকে তাদের প্রণয়ের  কথা শুনে এই বিবাহে উৎসাহী হয়। সেই মতো আমরা গিয়ে কথা এগিয়ে রাখি। 
----এত বড় খুশির খবর না জানালেও ইরার পড়ায় মন বসবে না বাবা।  আমি এক্ষুনি এই সুখবর টা ইরাকে দিয়ে আসি।
রঞ্জা  কোন কথাই তার বাবার শুনল না। এক ছুটে ইরার  ঘরে এসে ভেতর থেকে  দোর দিল।
---- বউমণি কলেজ থেকে ফিরে শাড়ি বদলাওনি এখনো ?
----বোন , তোমায় একটা সুখবর দিতে এলাম।
--- এই পোড়া কপালে আবার কি সুখবর দেবে শুনি?  কী বলবে বলো? 
---আগে বলো তুমি নিজে হাতে মসলা মাখা কাঁচালঙ্কা দিয়ে আম বাটা খাওয়াবে?
--- হ্যাঁ খাওয়াবো তুমি বলতো আগে
--- বোন  তোমার সাথে ইন্দ্রজিৎ দার বিয়ে পাকাপাকি হয়ে গেছে।
---- ইস ....আজকে জানলে আমাদের সম্পর্কের কথা আর আজকেই বিয়ে ফাইনাল করে দিলে?
---- বিশ্বাস হচ্ছে না তো?  তবে শোনো 
। বিশ্বাস প্রথমে আমারও হয়নি। তোমাদের সম্পর্কের কথাটা শোনামাত্র আমার মন বড় অস্থির হয়ে উঠেছিল। আমি মায়ের সাথে এ ব্যাপারে প্রথমে কথা বলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মা ব্যস্ত থাকায় তা হয়ে ওঠেনি। কলেজে যেতে,  আসতে এমনকি কলেজ  চলাকালীনও এ বিষয়ে অনেক ভেবেছি। অবশেষে কলেজ থেকে ফিরে বাবার কাছে তোমাদের সম্পর্কের কথা বলতেই উনি বললেন মা বাবা এমন কি তোমার দাদাও ইন্দ্রজিতের বাড়ি গিয়ে বিয়ের কথা বলে এসেছেন।  তবে  বিয়ে টা এখনই  হবে না । দু বছর পর স্কুল ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পর বিয়ে দেবে।
 ---তুমি সত্যি বলছো বউমনি? আমার যে নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না । তুমি অসাধ্য সাধন করলে। বউ মনি তোমার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকলাম। আমার যে আজ কি আনন্দ হচ্ছে তা তোমায় বলে বুঝাতে পারব না।
--- আমি আর কি   করলাম। তোমার দাদাই তো সকলকে বুঝিয়ে এই বিয়ে তে রাজি করিয়েছে। সত্যি ই বোন , তোমার দাদা মানুষ হিসাবে একজন আদর্শ পুরুষ। তোমার দাদা কে স্বামী রূপে পেয়ে আমি ধন্য।
দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেল। এই কয়েকদিনে ইন্দ্রজিতেরও এই বাড়িতে যাতায়াত বেড়েছিল । উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই অগ্রহায়ণ  মাসে তাদের বিবাহ স্থির হল। সেইমতো চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে ইরাবতীও পাড়ি দিলো নতুন সংসারে ঠিকানায় । ইরাবতী কে ছেড়ে রঞ্জা  বড় একা হয়ে পড়ল। সারা দিন মনমরা হয়ে থাকা বিষন্নতায় ভরা রঞ্জার মুখ খানি দেখে তারকনাথ বাবুর আরও বেশী করেই ইরার কথা মনে পড়তো। 
---রানি মা 
---বাবা কিছু বলছো?
---প্রাণের দোসর কে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয় সে  আমরা বুঝি। কিন্তু ইরাকে যে স্বামীর ঘরে যেতেই হত।এটাই যে  মেয়েদের নিয়ম।
 ইরাবতী অষ্টমঙ্গলায় আসলে রঞ্জাবতী পঞ্চ ব্যঞ্জন রেঁধে ননদ নন্দাই কে খাওয়াল। দুপুরের ভোজন শেষে চলল পারিবারিক আড্ডা। 
---ইরা, তোকে ছেড়ে তোর বৌমনি সবসময় গুম হয়ে থাকে। তোর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এই বাড়িটা সত্যিই খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে রে। 
---কই? ফাঁকা কই মা? আমি তো দেখছি তোমার ঘর আলোয় ভরা।
 ----কি সব হেঁয়ালি করছিস বলতো? বিয়ের পর মাথাটা গেল নাকি?
---আমার মাথা ঠিকই আছে। বাবাকে দেখো ঠিক বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসছে।কিগো বউ মনি এইতো সময় এখনই সুখবরটা সকলকে বলে দিই তাহলে ।এই চৌধুরী বাড়ি আলো করে বউমণির কোলে একটা ছোট্ট সোনা আসতে চলেছে। 
এই সুখবরে রঞ্জাবতী কে ঘিরে আবার খুশির আলো ছড়িয়ে পরলো।

সমাপ্ত
সকল বন্ধুদের অনুরোধ রইলো এই ধারাবাহিক গল্পটি কেমন লাগলো কমেন্ট করে জানানোর জন্য। আমার পরবর্তী ছোট ও ধারাবাহিক গল্প গুলিও সকলকে পড়ার অনুরোধ রইলো।

ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ