রঞ্জাবতী( পারিবারিক গল্প) সপ্তম পর্ব
---আমি ! আমি বউমণিকে, বিরক্ত করছি?বউ মনি তুমিই বলো, আমি কি তোমায় বিরক্ত করছি ?
শান্ত, ধীর কন্ঠস্বরে রঞ্জা বলল--
না, না ! বোন আমায় বিরক্ত করে নি। বরঞ্চ ও আমার সাথে আছে তাই আমার ভাল লাগছে।
--- প্রিয়বতী দেখ দেখ, তোর ছোট বোন আজকের মধ্যেই তার বউমণিকে কব্জা করে ফেলেছে।
---ওই জন্য তো.... ওই জন্যই তো গায়ে হলুদের গিয়ে আর আসেনি। একেবারে নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
বউমণি তুমি মুখে যাই বলো না কেন, আমরা তো জানি আমাদের ইরাবতীর গুন। যার সাথে একবার বকবক করতে শুরু করবে তার মাথা ঝাঁঝরা করে ফেলবে একেবারে।
একসঙ্গে এতগুলো ননদের বাক্যবাণে, হাসি-ঠাট্টার শব্দে যে ঘরটা কিছুক্ষণ আগেও নিস্তব্ধ ছিল সেই ঘরটা এখন গমগম করছে। সদ্য বিবাহিতা রঞ্জা তার ননদ দের কার্যকলাপ দেখে আরষ্ট হয়ে খাটের এক কোনে বিট ধরে বসে থাকল চুপটি করে।
--- এই তোমরা সবাই একসঙ্গে এখানে হইচই করছ কেন? যে জন্য ডাকতে এসেছো সেটা তো বেলমালুম ভুলেই গেছ দেখছি তোমরা । নিজেদের মধ্যে আনন্দ করতেই ব্যস্ত।
প্রিয়বতী বলল-- এটা কিন্তু ইরা ঠিকই বলেছে। আর বেশি দেরি করা উচিত হবে না । তোমরা সকলে পাশের ঘরে যাও। আমি আর ইরাবতী মিলে বউমণিকে সাজিয়ে দেবো।
শাড়ির আঁচলে টান দিয়ে রূপবতী র ছয় বছরের মেয়ে নিলিয়া বলল-- মাসী মনি আমাকেও সাজিয়ে দেবে ?নতুন মামীকে সাজানো হয়ে গেলে আমাকে সাজিয়ে দিও কিন্তু।
নীলিমার গাল দুটো দুই হাত দিয়ে হালকা টিপে ইরাবতী বলল আমার নিলিয়া মনিকে আমি সাজিয়ে দেব তো খুব সুন্দর করে। আগে তোমার নতুন মামীকে সাজানো হয়ে যাক। তারপরে কেমন? তুমি এখন বাইরে গিয়ে খেলা করো। আমি তোমাকে ডেকে নেব ।
---তুমি একটু নিচু হও ছোট মাসি মনি... -----কেন বলতো? নিচে হব কেন ? আচ্ছা বেশ , এই হলাম?
--- এবার চোখ বোজ।
---হমম বুজলাম।
---উ মম আ হ্হঃ আমার সোনামাসী।
অমনি একগালে হাম্পি দিয়েই নিলিয়া ছোট ছোট পায়ে ছুট দিল ।রূপবতী র এই একটি মাত্র কন্যা। আর প্রিয়বতীর সবে মাস ছয়েক হল বিয়ে হয়েছে।
সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রঞ্জাকে দুধে আলতা রঙের বেনারসী পড়ানো হলো। ইরাবতী সুন্দর করে রঞ্জার কপালে চন্দন দিয়ে কলকা এঁকে দিলো। সুলোচনা দেবী একসঙ্গে অনেকগুলো গহনার বাক্স রেখে গেলেন। বললেন সমস্ত গহনা দিয়ে বৌমাকে কে সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে।ভারী ভারী সাবেকি গয়নায় সেজে উঠল নববধূ। গলায় চিক থেকে শুরু করে বিচে হার, সাতমনি হার, সিতা হার, হাত ভর্তি মোটা মোটা সোনার বালা, কঙ্কন, কানে টানা দেওয়া সোনার ঝুমকো, এমন কি হিরের কাজ করা সোনার টিকলি ও।
-- ইরা, তো_দের সাজানো হলো?আমার রানি মাকে এবার নিয়ে আয় তোরা। বৌভাতের মণ্ডপে আমন্ত্রিতরা সকলে আসতে শুরু করেছে।
-- হ্যাঁ এইতো হয়ে গেছে বাবা। যাচ্ছি।
ঘর থেকে বেরনোর আগে প্রিয়বতী রঞ্জার পানপাতার মতো মুখখানি দুটো আঙ্গুল দিয়ে সামান্য উপরে তুলে বলল-- তোমায় কত্ত সুন্দর লাগছে বউ মনি। আমার সাথে এই দিকে এসো। এই বার দেখে বলোতো নিজেকে কেমন লাগছে ?
এত বড় আয়না আগে কখনো দেখেনি রঞ্জা। এর আগে কখনো নিজেকে মাথা থেকে পা পুরোটা দেখার সুযোগ কখনো পায় নি। ঘরের একদিকে সম্পূর্ণ একটা দেয়ালজুড়ে একটা বিশাল আকার আয়না। পর্দা দিয়ে ঢাকা ছিল তাই এতক্ষন রঞ্জার সেটির উপর দৃষ্টিগোচর হয় নি। সত্যি তাকে আজ রানি মায়ের মতোই লাগছে । সে নিজেই নিজের এই রূপ দেখে অবাক হয়ে গেল। আয়নার সামনে অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো। তারপর ইরাবতী পিছন থেকে রঞ্জার কাঁধ খানি আঁকার করে ধরে বলল-আমার বউমণিকে যেন কেউ আজ নজর না দেয় । একটু কাজল এর টিকা দিয়ে দি ই ছোট করে। রঞ্জা ঈষৎ লজ্জা পেয়ে আয়নার দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে হাসলো একটু।
প্রিয়বতী ও ইরাবতী দুজনে মিলে তাকে বৌভাতের মন্ডপে দিকে নিয়ে গেল।ঠিক এইসময় কিশোরীলাল ও তখন হন্তদন্ত হয়ে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে যাচ্ছিলেন। আকস্মিকভাবেই রঞ্জা দের দেখে দাঁড়িয়ে পরে। এই সময় রঞ্জা ও কিশোরিলাল এর মধ্যে একটু দৃষ্টি বিনিময়ও হয়। অপলক দৃষ্টিতে সে কিছুক্ষন রঞ্জার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মুখের কাছে হাত নাড়া দিয়ে প্রিয়বতী বলে-- কি রে দাদাভাই, বৌমনিকে কিছু বলবি?
--হ্যাঁ ... মানে না.... কই ! কিছু বলার ছিল না তো !
আসলে জানতে চাইছিলাম সরিষাপুর থেকে সকলে এসে গেছেন কিনা ?
---তা কি করে ও জানবে বাপু? ওকে তো আমরা সাজছিলাম ।
---ওহ ! আচ্ছা ।
---দাদাভাই তোমার এখন ইচ্ছে হচ্ছে বউমণির সাথে একটু কথা বলতে তাই তো? তা বলো না... কে বারণ করেছে... আমরা তবে চললাম।
এক কথা বলেই ইরা ও প্রিয়বতী একে অপরকে হালকা ঠেললো। রঞ্জা পড়লো মহা ফ্যাসাদে । চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার যে এখন আর কিছু করার নেই।
---দাদাভাই ... ওরকম আমতা-আমতা করে এটা ওটা কথা ঘুরানোর কি কোন প্রয়োজন আছে? আমরা কিন্তু সব বুঝি।
--- এই তোরা দুজনেই আমার থেকে বয়সে ছোট। এমনকি তোদের বড়ো দিদিরূপবতী ও। তোরা আমার সাথে ফাজলামি করছিস?
দাদা বোন এই মিষ্টি মধুর ফাজলামি খুনসুটির রঞ্জা সামনে থেকে বেশ উপভোগ করছিল। সে ও মুখ টিপে মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে মুচকে হেসে চলেছে তখন ।
--- দাদা ভাই তুই এমনিতে রাশভারী, কথা কম বললে কি হবে আজ তোর জন্যই এতক্ষন পর বউমণির ঠোঁটের কোনে হাসি ঝিলিক দেখা দিল। তোর দায়িত্ব রইল সারাজীবন বউমণিকে হাসিখুশি রাখার। তাকে কষ্ট না দেওয়ার। এখন আমরা চললাম বউমণিকে নিয়ে মণ্ডপে দিকে ।
ওরা চলে যাওয়ার পরও কিশোরীলাল সেখানে কিছুক্ষণ আনমনে দাঁড়িয়ে থাকলো।
সন্ধ্যার সময় গ্রাম থেকে রঞ্জার বাবা আত্মীয়রা এসে উপস্থিত হলেন ।চারিদিকে আলোয় মোরা রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি থেকে গ্রাম থেকে আগত সকল পাড়া-প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে দেখতে থাকলো। এমন বাড়ি ওদের গ্রামের জমিদারদেরও নেই। তারকনাথ বাবু ব্যস্ত হয়ে প্রায় এক প্রকার ছুটে এসে রাজনারায়ন কে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করে কুশল বিনিময় করলেন। রাজনারায়ণ এর চোখে তখন জলে পরিপূর্ণ ।
---আরে দেখো দেখি... একবেলা তেই কন্যাকে ছেড়ে নিজের শরীরের কি অবস্থা করেছেন ! ওদিকে আমার রানি মা এর ও যে মুখ ভার। কতক্ষণ সে আপনাকে দেখেনি। চলুন রানি মায়ের কাছে।
রাজনারায়ণ কে দেখামাত্র রঞ্জাবতী উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বাবার বুকে মাথা গুজলো।
একমাত্র কলিজা কে ছেড়ে রাজ নারায়ণেরও যে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সেও মেয়েকে আদরে, চুম্বনে ভরিয়ে দিল। এরই মাঝে কিশোরীলাল রাজনারায়ন কে প্রণাম করলেন ।
---আপনাদের আস্তে কোন অসুবিধা হয়নি তো বাবা?
-- না... না! বাবা জী_বন কোনো অসুবিধা হয়নি। আমি আবারো বলছি বাবা জীবন, তুমি আমার এই মেয়েটির খেয়াল রেখো ।কোন আঘাত দিও না কেমন ? ওর ভুলভ্রান্তি গুলো ওকে বুঝিয়ে বলো ও ঠিক শুধরে নেবে। রঞ্জা আমার তেমন মেয়ে নয়। ও বড় শান্ত ।
কথাগুলো বলতে বলতে রাজনারায়ন এর গলা বেয়ে জলের ধারা সরলরেখা হয়ে ঝড়ে পরলো। রাজনারায়ণ তৎক্ষণাৎ তা মুছে ফেলে বললেন তা বাবা জীবন তোমার মা কে দেখছি না...উনি যদি ব্যস্ত না থাকেন ওনাকে কি একটু ডাকা যাবে?
--- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বাবা... আমি এক্ষুনি আনছি।
---নমস্কার দিদিভাই। ভালো আছেন তো? ---হ্যাঁ আজ তো আমারই ভালো থাকবার দিন । ঘর আলো করে অমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করেছে যে,
জোড়হাত করে রাজনারায়ন বলেন--- যদি অনুগ্রহ করে অষ্টমঙ্গলায় মেয়ে জামাইকে পাঠান তবে খুশি হতাম ।
---এভাবে হাতজোড় করে কেন বলছেন? আমাদের সম্পর্ক এখন আত্মীয়তার। নিশ্চয়ই পাঠাবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে দাদা। শর্তের কথা শুনে রাজনারায়ায়নের বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো। মনে একটা অজানা ভয় বাসা বাঁধলো। তবে তা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্যই সীমিত ছিল । তার এই ভয় কে নিমিষে কাটিয়ে সুলোচনা দেবী বলেন আমার শর্ত হলো আপনাকে ওখান থেকে গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমাদের তো নিজেদের গাড়ি আছে। তাই এই গাড়িতে করে মেয়ে-জামাইকে আমরা পাঠিয়ে দেবো। আপনি তো এসে নিমন্ত্রণ করলেন তাতেই যথেষ্ট। আপনার এই দুর্বল শরীর নিয়ে বেশি ছুটোছুটি ব্যস্ত হতে হবেন না। আপনি সুস্থ থাকুন , ওষুধ গুলা ঠিকমতো খাবেন । আপনাকে কথা দিলাম আপনার মেয়ে কে আমি স্নেহের আঁচলে আগলে রাখবো। আমার তিন মেয়ের মতোই ও যে আমার মেয়ে।
চলবে...
( গল্পটি কেমন লাগছে ? সকল বন্ধুদের অনুরোধ রইলো কমেন্ট করে জানানোর জন্য। ভালো/ খারাপ যাই লাগুক । নির্দ্বিধায় বলতে পারেন কমেন্টে র মাধ্যমে। আমি ভুল ত্রুটি শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। সকল বন্ধুদের জানাই শারদীয়া র প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আমার প্রবাসী বন্ধুদের জন্যও রইলো শারদীয়ার শুভেচ্ছা ও অসংখ্য ভালোবাসা।)
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ