রঞ্জাবতী( পারিবারিক গল্প) অষ্টম পর্ব
রাজনারায়ণ বাবু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বহুকাল তার জীবনে কোন সুখের লেশমাত্র ছিল না । এই দৃশ্যও যে যে তার প্রাপ্তি ছিল, সেই খুশিতে সে মনে মনে অদৃষ্টকে শতকোটি প্রণাম জানালেন।
একটা বাক্সবন্দী ছোট প্যাকেট এনে তিনি রঞ্জার হাতে দিয়ে বললেন এটা রেখে দিস সযত্নে। ইরাবতী বয়সে বড় হলেও কৌতূহলটা এখনো বাচ্চাদের মত।
--- মেসোমশাই, আপনি বউমণিকে কি উপহার দিলেন?
ইরার এই রূপ কথায় প্রিয়বতী লজ্জায় লাল হয়ে ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বললে--- তোর সব কিছুতেই এত বাজে কৌতুহল কেন রে ? কোথায় কি বলতে হয় তাও জানিস না? দাঁড়া মাকে বলছি।
--- আরে না না! আমি একটুও অসন্তুষ্ট হয়নি ইরার কথায়। ও তো আমার রঞ্জা মায়ের থেকেও বয়সে ছোট। ওর উৎসাহ থাকাটা তো স্বাভাবিক। প্যাকেটেটায় রঞ্জার মায়ের একটা বাঁধানো ছবি আছে। মন খারাপ থাকলে ওই ছবিটার সামনে একটু সময় কাটায় ও । তাই সঙ্গে করে এনেছিলাম ওকে দেব বলে।
---আমি খুবই দুঃখিত মেসোমশাই । আমার ওই ভাবে জিজ্ঞাসা করাটা উচিত হয়নি । আপনি মনে করে ছবিটা এনে ভালোই করেছেন। মেসোমশাই আপনি অনেকটা দূর থেকে এসেছেন। আপনার শরীরটাও দুর্বল। আর রাত করবেন না। এবার খেয়ে নিন। চলুন আপনাকে খাবারের স্টলের দিকে নিয়ে যাই।
বাড়ি ফেরার সময়ে রঞ্জার আবেগঘন করুন মুখখানি দেখতে রাজ নারায়নবাবুর একটুও ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু কর্তব্যের স্বার্থে দেখা করতে বাধ্য হলেন। রঞ্জা ও চোখের জলে তার বাবা কে বিদায় দিলো। এত বড় বাড়ি, এমন সজ্জন পরিবারের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে রাজনারায়নের ঘর আজ সম্পূর্ণ ফাঁকা।
---রানি, এনার সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হলেন ইন্দ্রজিৎ। আমার প্রিয় বন্ধু আশুতোষের একমাত্র পুত্র। কলকাতার একটি কলেজে প্রফেসরি করেন।
রঞ্জা দুই হাত জোড় করে নমস্কার জানাল।
--- তবে এর আরো একটি পরিচয় তুমি পাবে। এনাকে ভাল করে চিনে রেখো। ইনিই হবেন তোমার গৃহশিক্ষক। অবশ্য ও আমার পুত্রসম। কিশোরীর চেয়ে বয়সে কিছু ছোট হবে।
রঞ্জা যেন আকাশ থেকে পরলো। এইসব কোনো কথাই তার মাথায় ঢুকছিল না। সে অবাক হয়ে তারকনাথ বাবুর দিকে চেয়ে রইল ।
---আরে পাগলি , এমন হা হয়ে গেলি যে বড়ো? তোর বাবার যে মনে বড় আশা ছিল তোকে অনেক দূর পড়াশোনা করাবে আর আমি আরেক বাবা হয়ে সেই আশাটা পূর্ণ করতে চাই। সেটা চাস না বুঝি? তবে এই ব্যাপারে প্রথম সিদ্ধান্তটা কিশোরীলাল ই নিয়েছিল। যেদিন তোর বাবা প্রথম আমাদের বাড়ি এসে কিশোরী লালের সাথে সাক্ষাৎ করেন সেদিনই তার জমানো সকল ব্যথা কিশোরীর কাছে উজাড় করে বলেন। তাই কিশোরী সিদ্ধান্ত নেয় বিবাহের পরেও যাতে তোর পড়াশোনার কোনো রকম বিলম্ব না হয়।
রঞ্জা মনে মনে কিশোরীকে কৃতজ্ঞতা জানাল । ভালোবাসা জন্মানোর আগেই কিশোরীর প্রতি তার সম্মান ও শ্রদ্ধা আরও গাঢ় হলো । মানুষটি মুখে তেমন কিছু না বললেও মনে মনে তাকে নিয়ে এতটা চিন্তা করে তা শুনে বেশ খুশী হল সে। কিন্তু এই খবরটা তার বাবা জেনে গেলে তিনিও অনেকটা খুশি হতেন। রাজনারায়ন বাবুরা ততক্ষণে রওনা দিয়েছেন সরিষাপুরের উদ্দেশ্যে।
নববধূকে তিন ননদ মিলে হাত ধরে ফুলশয্যার ঘরে নিয়ে এল। রজনীগন্ধা গোলাপ ছাড়াও হরেক রকম বাহারি পুষ্পের সমাহার দিয়ে সেই শয়ন কক্ষ সাজানো হয়েছে। ফুলের মিষ্টি সুবাসে কুঞ্জ মহিমান্বিত। সুসজ্জিত পালঙ্কের উপর রঞ্জা কে বসিয়ে তার তিন ননদ বিদায় নিল। কিছুক্ষণ পরেই কিশোরীলাল প্রবেশ করলেন কক্ষের মধ্যে। এমন সময় রঞ্জার মনে এক অজানা ভয় বাসা বেঁধেছে। কারণ এর আগে সে কিশোরী লালের সাথে কথা বলেনি। সম্পূর্ণ অচেনা একটা মানুষ তায় আবার পুরুষ। একাকী বসে ঘরের মধ্যে বসে যতই ভাবছে এইসব কথা ততই এই বৈশাখের ভ্যাপসা গরমে সে আরো দ্বিগুন ঘেমে যাচ্ছে। কিশোরীলাল কক্ষে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি দিতেই সেই শব্দে রঞ্জা চমকে উঠে একটু নড়েচড়ে বসে। সে ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে হাত দুটো কোলের কাছে জড়ো করে এক প্রকার গুটিসুটি হয়ে বসে রইলো। কিছুক্ষণ দু পক্ষের কেউই কোনো বাক্যব্যায় করল না। তারপর কিশোরীলাল গলা ঝেড়ে নিচু স্বরে বললো-- রঞ্জা তোমার সাথে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে। আমি চাই তুমি তার উত্তর অন্তর থেকে দাও।
--- ঢোক গিলে খানিকটা আমতা আমতা করে ক্ষীণ স্বরে রঞ্জা বলল ---বলুন কি বলবেন ? আমি আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।
--- তুমি আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। আমার ছোট বোন ইরাবতী রই প্রায় সমবয়সী । এই বিয়েতে কি তোমার সম্পূর্ণ সম্মতি ছিল?
--- অজ্ঞে, বিবাহের জন্য নির্বাচিত পুরুষটির জন্য আমার কোন আপত্তি ছিলো না। তবে এই বয়সে বাবা কে ছেড়ে বিয়ে করাটাতেই ছিল আমার চরম আপত্তি। আপনি তো জানেন বাবার একমাত্র অবলম্বন আমি। আমায় নিয়ে তিনি অনেক স্বপ্ন বুনতেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত না করতে পারার জন্য....
রঞ্জা পুরো কথা টা শেষ করতে পারলো না। বুকের মধ্যে থেকে গলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলো গুমোট কান্নার স্রোত।
--- বুঝেছি। কিন্তু রঞ্জা আমি তোমার থেকে অনেকটা বড় হলেও আমি তোমার স্বামী। আমাকে' আপনি 'বলে কথা না বলে 'তুমি' সম্বোধন করলে বেশি খুশি হব।
---- আচ্ছা ঠিক আছে।
ছোট লাল বাক্স এর মধ্যে রাখা একটি হীরের আংটি ড্রয়ার থেকে বার করে কিশোরীলাল বললেন ---রঞ্জা তোমার হাতটা দাও। লজ্জা পেও না। রঞ্জা মাথা নিচু করেই তার হাতটা কিশোরী লালের দিকে এগিয়ে দিল তখনও ওর হাত- কাঁপছে।
আমার তরফ থেকে এটি তোমায় দেওয়া বিবাহের উপহার বলে কিশোরীলাল অঙ্গুল এ পরিয়ে দিলেন। তবে তোমায় দেওয়া আমার শ্রেষ্ঠ উপহারটা এবার দেবো। তুমি এ উপহার কোনদিন কাউকে দেখাবে না । কথা দাও আমায় , এমনকি তোমার ওই নতুন সখি ইরাকেও নয়। তখনো আংটি পরিহিত কোমল হাত খানি কিশোরী লালের হাতের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। সুতরাং সে মুখে কোনো প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হলো না।
আর হাতের তালুতে একটি হলুদ খাম দিয়ে কিশোরী বললে এটি অবসরে পড়ো কেমন ? আমার সামনে পড়তে হবে না। সযত্নে রেখে দিও । খানিক টা গম্ভীর হয়ে সে বলল আবারও বলছি তোমায় ওই অল্পবয়সী ইচরে পাকা ইরাকে যেন ভুলেও দেখিও না চিঠিখানা।
ইরা শুধুমাত্র ঘাড় নেড়ে তার কথার সম্মতি জানাল।
---রঞ্জা আগামীকালই আমাদের এখানকার একটি স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয় এ তোমার ভর্তির জন্য যোগাযোগ করব ।
প্রতুত্তরে কিছুই বলল না সে। সে শুধু ভাবতে বসলো ---
হায়রে পোড়া কপাল! ফুলশয্যার কক্ষে এসে আজকের এই মধু ময় রাত টা কি এইভাবেই কাটিয়ে দেবে নাকি পুরুষটা? কত বান্ধবীরই তো বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর তাদের ফুলশয্যা রাতের সেই রোমাঞ্চকর কত ঘটনাই সে শুনেছে। কাননের এর থেকেও তার ফুলশয্যার রাতের অভিজ্ঞতা সে গোগ্রাসে গিলেছে। সে সব কথা শুনতে শুনতে তার কান লাল হয়ে গিয়েছিল। শরীরের প্রত্যেকটি শিরায় অদ্ভুত এক শিহরন খেলছিল। সেদিন রাতে তার ঘুম আসে নি। সদ্য যৌবনে পরিপূর্ণা রঞ্জা সারারাত ভেবেছে কানন এখন বরের থেকে সত্যিই কত আদর , সোহাগ পায় । তার জীবনেও একদিন সেই আকাঙ্খিত রাত আসবে। কিন্তু তার ফুলশয্যার রাত টা যে এভাবে কাটবে এটা ছিল তার কল্পনারও অতীত। শশুর বাড়ি এসেও সে তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে এটা সত্যি তার কাছে খুশির খবর । কিন্তু এখন এসব আলোচনায় তার মন নেই। ঘোমটা টা একটু সরিয়ে আর চোখে রঞ্জা দেখল তার স্বামী ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। অগত্যা অনেকটা হতাশ হয়ে বিছানায় একপাশে সরে এসে আস্তে করে শুলো রঞ্জা।
--- বৌমনি তোমাকে তো সারা বাড়ি খুঁজছি। আর তুমি হেশেলে কি করছ এত সকালে? ইরার কথায় খানিক টা হেসে রঞ্জা বল্লো আশা কাকী কে শুধছিলাম....
রঞ্জার কথা সম্পূর্ণ শেষ না করতে দিয়েই ইরা বললো তুমি জানো না অষ্টমঙ্গলা না সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত নববধূকে আগুনের ধারে কাছে আসতে নেই । মা দেখলে খুব রাগ করতেন।
--- ও_মা তাই বুঝি ! আমি জানতাম না বোন ।বড় ভুল হয়ে গেছে। ঠিক আছে। এখন চলো তো আমার সাথে। ওদিকে বরদি মেজদি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
রঞ্জার হাতটা জাপটে ধরে প্রায় এক প্রকার টানতে টানতে দুতলার দক্ষিণের একদম শেষের ঘরে নিয়ে এসে উপস্থিত হলো। সেখানে প্রিয়বতী রূপবতী দুজনেই তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। বাইরে থেকে রঞ্জার পায়ের নুপুরের শব্দ পেয়ে তারা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো
চলবে ....
(পুজোর আমেজে লেখা নিয়মিত পোস্ট করতে পারছি না তার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। একদিন অন্তর পরবর্তী পর্ব আসবে।সকলে ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।)
ছবি : সংগৃহীত
1 মন্তব্যসমূহ
7D453D4B0D
উত্তরমুছুনhacker bul
hacker kiralama
tütün dünyası
hacker bul
hacker kirala