জামাই
কি গো এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছ ? বলি সকাল গড়িয়ে বেলা হয়ে এলো যে আজকের দিনেও কি বিছানা কামড়ে পড়ে থাকবে?
গিন্নির গলাখাকারি তো চোখ কচলিয়ে অরিন বাবু ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখেন, সবেমাত্র সকাল ছয়টা বাজে।
-- বলি তোমার কি কান্ডজ্ঞান নেই হা? এমনভাবে ঠেলেঠুলে ডেকে বললে কত বেলা হয়ে গেছে, আমি ভাবলাম না জানি কত বেলা হয়ে গেল।
-- তোমায় ও ভাবে মিথ্যে না বললে কি তুমি তড়িঘড়ি ধড়পরিয়ে উঠতে? বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠছি, উঠবো করেই তো আরো আধঘণ্টা কাটিয়ে দিতে।
--- এই উঠলাম । কি বলবে বলো? আজ কি এমন দিন শুনি? কিসের জন্য এত হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি তোমার?
--- কানের মাথা খেয়েছো নাকি ?কাল যে সোমা ফোন করে বললো ও শ্বশুর বাড়ি থেকে আসছে আমাদের বাড়িতে পুজোর তত্ত্ব দিতে জামাইয়ের সাথে। সে কথা বেমালুম ভুলে গেলে নাকি?
--- জিভ কেটে অরিন বাবু গিন্নিকে বলল-সত্যি ঘুমের ঘোরে একদম ভুলে গেছিলাম। আমাদের একমাত্র সন্তান সোমা, বিয়ের পর এই বছরেই ওর প্রথম দুর্গাপুজো । সবে তো মাস তিনেক হয়েছে বিয়ে হয়েছে। তাই মাঝে মাঝে ভুলেই যাই যে সোমা আমাদের ছেড়ে এখন গুছিয়ে দিব্যি সংসার করছে।
--- ওরা সকাল সকাল চলে আসবে। তাড়াতাড়ি উঠে মিষ্টি, সন্দেশ , মাছ, আনাজপাতি, মাংস সব কিনে আনো। আমি ময়দা মাখতে মাখতে তোমায় ডাকতে এসেছিলাম। যাই আলুর দম টা করে ফেলি গিয়ে। আর হ্যাঁ, তুমি ব্রাশ করে নাও । আমি চা গরম করে আনছি।অন্তত চা, বিস্কুটটা খেয়ে ধীরে, সুস্থে যেও। বেশি তাড়াহুড়ো করতে হবে না।
তোমার শরীর এখন বিশেষ ভাল যাচ্ছেনা। প্রেসার টা আবার বেড়েছে। বাজার বেরোনোর সময় মনে করে ছাতাটা নিয়ে যেও। আজ আবার রবি বার। খাসির মাংসের দোকানে হয়তো অনেক লাইন পড়বে । তাইতো সকাল-সকাল ডেকে দিলাম। যাতে ঠান্ডায় ঠান্ডায় বাজারটা করে নিতে পারো।
--- আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে । আমি ব্রাশ করে আসছি চা রেডি করো।
অরিন বাবু বাথরুমে ঢুকলেন। ওদিকে সোমার মাও রান্না ঘরে ঢুকলেন চা করতে। এমন সময়েই ডোর বেল বেজে উঠল। বাথরুম থেকেই অরিন বাবু চেঁচিয়ে বললেন দেখো তো কে ডাকছে
।
--- ওমা!! জামাই বাবা যে সকাল সকালেই এসে পড়েছে। তা ভালো করেছ। চড়া রোদ ওঠার আগেই সকাল-সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছ। তা ভালো আছে তো বাবা? এসো এসো ঘরে এসো। সোমা তোকে কি আবার নিমন্ত্রণ করে আনতে হবে। আয়।
মেয়ে, জামাই কে জল , চা- বিস্কুট খেতে দিয়ে সোমার মা অরিন বাবু কে তাড়া দিলেন ---" আরে তাড়াতাড়ি যাও মিষ্টিটা আগে আনো গিয়ে।
--- না না কিছু আনতে হবে না। আমরা আসার সময় মিষ্টি, দই ,ফল, মাছ, মাংস সব কিছু এনেছি। বাবাকে কোথাও বেরোতে হবে না। আমি সোমার মুখে বহুবার শুনেছি আপনি খুব সুন্দর রাধেন মা। তবে এর আগে ও কয়েক বার আমি নিজেও খেয়ে তা স্বীকার করেছি। আজ আপনি জম্পেশ করে রাধবেন। আর আমি কব্জি ডুবিয়ে খাবো । কতদিন হয়ে গেলো মায়ের রান্না খাইনি ।
মাতৃহারা জামাইয়ের মুখেএই কথা শুনে সোমার মায়ের মুখটা করুন হয়ে গেল।
--- আর বাবা , তুমি তো মাংস টা বেশ তেল ঝাল মশলা দিয়ে কষিয়ে ভালই রান্না করো
। আজ তুমি আর সুজয়(সোমার বর) দুজনে মিলে মাংস টা রান্না করবে। আমি আর মা বাকি রান্না গুলো করে দুপুরে জমিয়ে খাব।
--- সে না হয় হবে, অতো দূর থেকে এলি আগে মিষ্টি জল তো খেতে হবে।
---বাবা মিষ্টি নিয়ে চলে এসেছি প্লেটে সাজিয়ে। চলে আসুন মা। জমিয়ে মিষ্টিমুখ করি সকলে একসাথে।
--- এই দেখো কান্ড !! আমি সবে কলতলায় গিয়েছি চায়ের কাপ, ডিশ গুলো রাখতে। আর তুমি মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে চলে এলে বাবা।
--- মা আমি তোমাদের জামাই নই। তোমাদের ছেলে । আজ যদি আপনার ছেলে থাকতো ,আপনার হাতে হাত লাগিয়ে কাজ কি করত না সে? আমি কি নিজের হাতে প্লেট সাজিয়ে মা-বাবাকে মিষ্টি খাওয়াতে পারি না?
এতক্ষণ সুজয়ের কথাগুলো অরিন বাবু মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন আর মনে মনে ভাবছিলেন আমি হাজার খুঁজেও সুজয়ের মতো যোগ্য পাত্র সোমার জন্য পেতাম না। হীরের টুকরো সুজয়ের হাতেই প্রথমে সোমা কে তুলে দিতে নারাজ ছিলাম আমি । সোমা যদি জেদ না দেখিয়ে আমার কথা মেনে সুজয় কে ছেড়ে দিত তাহলে আমরা সুজয়ের মতো সরল, ছেলেমানুষ , দায়িত্ববান ছেলেকে চিরদিনের মতো হারাতাম ।
--- নিন, বাবা, মা খাওয়া শুরু করুন। আমার তো আর দেরী সইছে না।আমি মিষ্টি খেতে শুরু করলাম । খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো লজ্জা নেই। সোমা খাও খাও ।একটা দিন আনন্দ করে মিষ্টি খেলে মোটা হবে না।
মিষ্টি পর্ব শেষ হতেই অরিন বাবু স্ত্রী রান্নাঘর থেকে লুচি আলুর দম আনলেন।
--- আহা ! কি গন্ধ লুচি র। কি অপূর্ব স্বাদ আলুর দম টার। অনেক দিন পর মায়ের হাতের খাবারের গন্ধ পাচ্ছি।
সুজয়ের কথায় অরিন বাবু স্ত্রী মনে মনে ভাবলেন মাতৃ হীন সুজয়ের সত্যি ই একটু মায়ের স্নেহের খুব প্রয়োজন।
--- মা আমি রান্না ঘরে চললাম ।তোমায় কুটে, বেটে, দি গিয়ে।
--না রে সোমা তোকে কিছু করতে হবে না। তোকে তো সংসারে একা হাতে সব কিছুই করতে হয় অপটু হাতে। আজ না হয় বাপের বাড়ি এসে একটু রেস্ট নিলি।
--- একদম ছাড়বেন না মা ওকে।আপনার হাতে হাতে ওকে সাহায্য করতে দিন। আপনার পাশে থেকে যদি একটু রান্নাটা ভালো শেখে। আর আমি ঐদিকে মাংসটা রান্না করার জন্য বাবাকে হেল্প করতে চললাম।
দুপুরে একসাথে আনন্দে , গল্প কথায় খাওয়ার পর সোমা, সুজয়, অরিন বাবু ও তাঁর স্ত্রী সকলে মিলে গেল পূজার কেনাকাটা করতে। সুজয়ই দুই পক্ষের সকল কেনাকাটা করলো। অরিন বাবুর বারবার বলা সত্বেও তার কোনো টাকা সুজয় নিল না। কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরে সুজয় বললো-- " থাক না বাবা। আমি তো এখন বড় হয়েছি। চাকরি করছি ।সংসার হয়েছে ।এবার থেকে না হয় আমি আপনাদের সকল দায় দায়িত্ব নিলাম ।আমি জানি সোমা আপনাদের একমাত্র সন্তান। তাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হয় আপনাদের। কিন্তু আমি আপনাদের আগেও বলেছি এখনও বলছি আমাদের বাড়িতে আপনারা চলে আসুন। হাসি খুশিতে সকলে মিলে আনন্দ এ দিন কাটাবো।
--না, বাবা জীবন । তা কি করে হয়। আমরা এখন ভালো আছি। তোমরা গুছিয়ে সংসার করো। আশীর্বাদ করি জীবনে অনেক বড় হও। তোমার এই কথাতেই আমরা খুব খুশি। আমরা তো জানি তুমি আমাদের সবসময় বিপদে-আপদে পাশে আছো।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে সোমা, সুজয় বাড়ি ফিরে গেলে অরিন বাবুর স্ত্রী অরিন বাবু কে বলেন এমন হীরের টুকরো ছেলেকে আমরা হেলায় হারাতে বসেছিলাম। আজ থেকে সুজয় কেবল আমার জামাই নয় ।ও আমার ছেলে। ওকে আমি আর জামাই বাবা বলব না। ও আমার সোনা ছেলে। আমি ওকে আজ থেকে বাবু বলে ডাকবো।
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ