আমার বাবা

Ami

 

father and daughter


আমার বাবা

তখন নাকি চাহিদাটা তাঁর অন্যরকম ছিল। যদিও সেই মানুষটার সেই অমূলক,  উদ্ভট চাহিদা টার কথা আমি লোকমুখে শুনেছি। কিন্তু তাঁর চোখে আমি কখনই সেই চাহিদার আশা অপূর্ণের কোনো আক্ষেপ দেখি নি।


 আমি তনয়া। আমি একজন নিম্নমধ্যবিত্ত বাবার একমাত্র সন্তান। একটু বড় হতেই পারিপার্শ্বিক মানুষজনের কাছে শুনেছি আমার মা যখন প্রেগনেন্ট ছিলেন আমার বাবা নাকি মনে মনে আশা করতেন যে তার একটা  পুত্র সন্তান হবে। আর হাসপাতালে যখন প্রসব বেদনা নিয়ে ভর্তি হয়ে মা হওয়ার সমস্ত রকম কষ্ট সহ্য করে আমার মা যখন আমায় জন্ম দিল , কন্যা সন্তান হয়েছে বলে আমার বাবা নাকি ভ্রু কুঁচকে , মুখ কালো করে হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন  নেহাতই খুব ছোট ছিলাম। তাই তাদের মুখেএসব কথা শুনে খুব কষ্ট হতো। আমি বরাবরই খুব শান্ত, চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। কথাগুলো আমার মাথায় খুব সহজেই গেঁথে গিয়েছিল।  কিন্তু মা, বাবাকে কোনদিন এই কথাটা নিয়ে কোনদিন প্রশ্নও করিনি। নিজের মনের মধ্যেয়েই চেপে রাখতাম। বাবার ওপর খুব অভিমান ও হতো।


আমার বাবা ছিলেন পেশায় দর্জি। উপার্জন কম হলেও আমার বুদ্ধিমতী মা সংসারটাকে সুন্দরভাবে চালিয়ে নিতেন। বাবা প্রতি সপ্তাহের রবিবার কলকাতা থেকে পেটিকোটের (সায়া)  কাপড় কিনে আনতেন। আর সারা সপ্তাহ জুড়ে নিজে কাপড় কেটে পেটিকোট তৈরি করে তা বিক্রি করতে যেতেন বর্ধমানে। ওহঃ বলা হয়নি ।আমরা থাকি হুগলি জেলায়। সুতরাং বাবার এই ছোট ব্যবসাটার জন্য কখনো তাঁকে কলকাতা ,কখনো বর্ধমান এই ভাবেই একাই ছোটাছুটি করতে হয়েছে। কলকাতা থেকে ব্যবসায়িক মালপত্র( পেটিকোটের কাপড় , সুতো, কাঁচি, দড়ি ইত্যাদি)  আনার সময় বাবাকে দেখেছি প্রত্যেকবার আমার জন্য কিছু না কিছু আনতে। ট্রেনে ফল পেলে নিয়ে আসতেন , চিপস, গুড় বাদাম যা পেতেন। হ্যা,  অনেকেই মনে করতে পারেন এই সব জিনিস সকল পিতারাই নিয়ে আসেন তার সন্তানদের জন্য।


 কিন্তু আমার ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম। প্রতি সপ্তাহে এই ফল, গুড় বাদাম বাবদ যে বাড়তি খরচা হয় সেটুকুও অর্থব্যায়ের প্রভাবেও নাকি সংসার এর ঘানি  টানতে মায়ের বেশ অসুবিধা হতো।  তাহলে তখন আমাদের আর্থিক অবস্থার হাল কতটা নিম্নে  ছিল এইবার নিশ্চই বুঝতেই পারছেন । মা কিন্তু সংসারের অভাব এর কথা আমায় লুকিয়ে না  রেখে বলতেন। কিন্তু বাবার ছিল এতে ঘর আপত্তি। তিনি মা কে বলতেন এই সব সংসারের টানাটানির কথা বাচ্ছা দের বলতে আছে? তনয়া তো এখন ছোট ওর জন্য এই সামান্য  জিনিস যদি জোগাড় করতে না পারলাম তো সন্তানের জন্য আর কি করলাম। মা উল্টে বলতেন তোমার অস্কারাতেই মেয়ের দিন দিন আরো বায়না বেড়েছে। কিন্তু বাবা বিশেষ পাত্তা দিতেন না মায়ের এইসব কথায়। বলতেন , ছাড়োতো কি বা দিতে পারছি মেয়েটাকে একটু ফল , বাদাম ওতে কিছু আমার টান পড়বে না। 


এবার ওই কাপড় কেটে পেটিকোট তৈরি হয়ে গেলে বাবা সেইগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে, ভালোভাবে প্যাকিং করে ব্যাগে ভরে বর্ধমানের নিয়ে যেতেন বিক্রয় করতে। কিন্তু দোকানদাররা যে প্রতি সপ্তাহেই বাবাকে টাকা দিতেন তা নয়। পাওনাদার দের কাছ থেকে টাকা পাক আর নাই পাক - বাবা কিন্তু রাত এগারোটার ট্রেনে ফেরার পথে মাখা সন্দেশ ,সীতাভোগ কিন্তু আনতে ভুলবেন না আমার জন্য।


 যে বছর মাধ্যমিক দেবো  সে বছর পড়াশোনার চাপ টা স্বাভাবিক ভাবেই একটু বেশি ছিল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসলে বাবাকে বাইরে থেকে প্রায় দিনই বলতে শুনতাম,কিগো মেয়েটাকে একটা ডিম সিদ্ধ করে দাও। তনয়া  ম্যাগি খেতে খুব ভালোবাসে। আমি এখনই এনে দিচ্ছি। একটু করে দিও মেয়ে টাকে। এইসময় ওর পছন্দ মতো খাবার পেলে ওর পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়বে যে। সত্যি ই এইভাবে আমার যত্ন আর খেয়াল রাখতে শুধু বাবাকেই দেখেছি। তখন আমি যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি । তখন থেকে আমি আর মনে কষ্ট পাই না। আমি তো তখন থেকেই অনুভব করতে পারতাম  আমার বাবার জীবন জুড়ে কতো টা আমার বিস্তার। 


বাবা র নামে যে ভিত্তিহীন কথা গুলো আমি অন্যের মুখে শুনে ছোটবেলায় মনে মনে কষ্ট পেয়েছি বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই বাবা নামক মানুষটার কাছেই লাগামছাড়া ভালোবাসা পেয়েছি। আমার ছোট ছোট সব আবদার বাবা সাধ্য মতো মেটাবার চেষ্টা করেছেন। নিজের মাসিক উপার্জন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা সত্বেও আমার পড়াশোনার জন্য তিনি এক্সট্রা প্রাইভেট টিউটর রেখেছেন। সেই সকল প্রাইভেট টিউটরের মাসিক মাইনে  কি ভাবে দেবে সেই চিন্তা না করে শুধু আমার সার্বিক উন্নতি চেয়েছেন। মাসের শেষে ব্যবসায়িক মালপত্র না কিনে সেই টাকায় আমায় পড়িয়েছেন, মানুষ করেছেন এমনকি আমার জন্য লোন পর্যন্ত তিনি নিয়েছেন।


কোমরের অসহ্য স্পন্ডেলাসিসের ব্যাথা সহ্য করেও দিন রাত কাজ করে আমার পড়াশোনার খরচ চালিয়েচেন। এত কষ্টের মধ্যেও কোনোদিন ও কিন্তু মানুষটার মুখে শুনি নি যে তাঁর কন্যাসন্তান নয় একটা পুত্র সন্তানের ইচ্ছে ছিল। কোনো ভাব, ইঙ্গিতেও তা প্রকাশ পায় নি। আমি চেয়েছিলাম তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সাহায্য করতে কিন্তু তিনি রাজি হন নি। শুধু বলতেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও এটাই আমার স্বপ্ন, তাতেই আমার কষ্ট সার্থক।



আমি এখন প্রতিষ্ঠিত, বিবাহিতাও। আমি জীবনে যা কিছু হয়েছি সেই বাবার আত্মত্যাগের জন্যই। আজ দীর্ঘ এতগুলো বছর পর আমি ভাবি ভাগ্যিস ঈশ্বর  আমায়  শান্ত প্রকৃতির মুখচোরা মেয়ের গুন দিয়ে জন্ম দিয়েছিলেন। না হলে সেদিন যদি লোকমুখে শুনে সেই প্রশ্ন এর-উত্তর বাবার থেকে চাইতাম তাহলে আজ হয়তো বাবার মুখপানে চেয়ে বলতে পারতাম না -- "বাবা তুমি কেমন আছো? ভালো আছো তো? "


(গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। ভালো লাগলে বন্ধুরা অবশ্যই কমেন্ট করবেন। এবং সকলের সাথে শেয়ার করবেন। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।)


ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ