অষ্টমীর অঞ্জলি ( প্রথম পর্ব)
পরপর বেশ কয়েকটা বছর ভালো ভাবে দুর্গা মাযের অষ্টমীর অঞ্জলি টা দেয়া হয়নি সহিনীর। তবে এই বছরটা , ও বেশ আশাবাদী ছিল । ভেবেছিল দু বছরের মেয়ে অঞ্জলীকে কোলে বসিয়ে সুস্থভাবে সব মন্ত্র উচ্চারণ করে মা দুর্গার চরণে অঞ্জলীর ফুল নিবেদন করবে। না !! তা আর হয়ে উঠলো না। এবছরও সে ডাহা ফেল করল এ ব্যাপারে। প্রথম রাউন্ডের মন্ত্র বলা হয়ে গিয়েছিল। আর দুটো রাউন্ড ভালোভাবে উতরে গেলেই সহিনীর মন টা অনেক টা শান্তি পেত। তার কপালে এই বারেও মায়ের অঞ্জলি যে লেখা নেই। অঞ্জলীর সময় কোলে বসে থাকা সহিনীর দু বছরের মেয়ে অঞ্জলি হঠাৎই বায়না ধরল "ম্মামা ওঠো ..না বাইরে চলো না... । অঞ্জলীর কানের কাছে মুখটা এনে সোহিনী তাকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করল-- " সোনা মা এখন কথা বলতে নেই , ঠাকুর মশাই রাগ করবেন তো। এক্ষুনি হয়ে যাবে । একটু বোঝো চুপ করে বসো।' কিন্তু কে কার কথা শোনে। বায়না করতে করতে অঞ্জলি এমন চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো সোহিনী আসন ছেড়ে উঠে আসতে বাধ্য হলো।
অঞ্জলি পর্ব শেষ হতেই বন্ধুবান্ধবরা তাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে আরো রাগাতে শুরু করলো। রিম্পা বলল " সোহিনী এই বছরেও কিন্তু মিস করে গেলি"। যে যাই বলিস অঞ্জলি কিন্তু খুব কিউট হয়েছে এক্কেবারে ওর বাবার মতো। প্রিয়মের কথায় সোহিনী বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-- হ্যাঁ মেয়ে তো বাপের মতোই হবে। যে বছর থেকে সোম এর মুখদর্শন পেয়েছি সেই বছর থেকেই এই শুভ দিনটা আমার এইরকম যাচ্ছে।
সোম বরাবরই খুব মিশুকে, হুল্লোড়বাজ কিন্তু পড়াশোনায় যথেষ্ট মেধাবী। পাড়ার, স্কুলের সব বন্ধুদের কাছে সে টেনশন হটানোর বন্ধু নামে পরিচিত। অর্থাৎ সোম জীবনের ছোট ছোট দুঃখ কষ্টের টুকরো গুলোকে তুরি মেরে হটাতে পটু। তাই বন্ধুমহলে কারো নতুন প্রেম ভেঙে গেলে, কিংবা প্রপোজ করে কেউ ব্যার্থ হলে তার কাছে চলে আসে মন টা হালকা করতে। সোম এত সুন্দর এইসব ব্যাপার গুলোকে হ্যান্ডেল কোরে রোমিও গুলোকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসে তা আর বলার নয়। আসলে সোমের কাছে বড় কথা হলো জীবন টা উপভোগ করার জিনিস। কারো জন্য কেঁদে চোখ ফলানোর জন্য জীবন নয়। অন্তত টিনএজ সময় তো একদম ই নয়। তার কথায় এই সময় টা পরিমিতি, উপপাদ্য, করণী , ইতিহাস , উপন্যাস , ক্রিকেট, ফুটবল এইসব নিয়ে মেতে থাকার বয়স। সো এইবয়স এ প্রেমে ব্যার্থ হলে মন থেকেই সেই পাগলী কে ঢিস্ক্যাও করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
সোমের বাবা একজন হার্ট স্পেশালিস্ট।
তার বরাবর ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর ডাক্তারি নিয়ে পড়াশোনা করবে। কিন্তু সোমের প্রথম থেকেই স্বপ্ন ছিল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার । তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর জয়েন্ট পরীক্ষায় পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পাওয়ার পরই সে কলকাতার বাইরে যায় পড়াশোনার জন্য। সোমের বাবা ডাক্তার অরিন বিশ্বাস কিন্তু ডাক্তারি পড়ানোর জন্য সোম কে খুব চাপাচাপি করেন নি। সোমের মতা মতের যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন তিনি। কিন্তু সোমের মা সুলেখা দেবী একমাত্র ছেলেকে কলকাতা ছেড়ে অন্য জায়গায় পড়াশোনার জন্য পাঠাতে ছিলেন নারাজ। কিন্তু সোম তার মা কে বোঝায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে এইটুকু স্যাক্রিফাইস তো তোমায় করতেই হবে মা। আফটার অল তুমি হলে সোমের মা। সোম কোনো ব্যাপারে ওতো টেনশন খায় না। সো তোমাকেও টেনশন নিতে হবে না মা। আমি কথা দিলাম যে ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে পড়াশোনা শেষ করেই আবার তোমার কাছে চলে আসব। ঘড়ি ধরে সকাল নটায় তোমার হাতের রান্না খেয়েই অফিস বেরোবো। যে রুটিং টা স্কুল লাইফ থেকে চলে আসছে সেটাই হবে। মানে ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে আর বাইরে নয়। কলকাতাতেই থেকে চাকরি করবো।
সোমের কথায় সুলেখা দেবীর ভয় টা অনেক টা কেটে যায়। সোম ও পড়াশোনার জন্য বাইরে চলে যায়। মা কে কথা দিয়ে যায় তিন মাস অন্তর ছুটিতে কলকাতায় ঠিক তার মায়ের কাছে চলে আসবে। প্রথম প্রথম কোন কারণে কলেজ টানা এক সপ্তাহ ছুটি থাকলেই সোম চলে আসতো কলকাতায় । সারাটা দিন পুরোনো বন্ধু দের সাথে আড্ডা, বাড়িতে মায়ের সাথে খুনসুটি, মায়ের আদর , মায়ের তৈরি ফেভারিট খাবার খেতে খেতে তার সপ্তাহ কিভাবে কেটে যেত টের পেত না। কিন্তু সেমিস্টার যত বাড়তে থাকে, ততই পড়াশোনার চাপ বেশী হতে থাকে তাই ছুটি থাকলেও আর কলকাতায় সব সময় তার ফিরে আসা হতো না। সুলেখা দেবীও তখন সোমের অবস্থাটা বুঝতে পারতেন।তাই আর বাড়ি আসার জন্য জোর করতেন না ।তবে সোম নিয়ম করে বাড়িতে সারা দিনে দু থেকে তিন বার ফোন করে তার মায়ের খোঁজ খবর নিতো। ব্যাঙ্গালোর এও তার বন্ধু-বান্ধব এর সংখ্যা কম নয়। সদা চঞ্চল, মিশুকেসোম সব জায়গাতেই সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারতো। পাড়ার বন্ধুবান্ধব ও স্কুল লাইফের বন্ধু বান্ধবের সাথেও সোশ্যাল নেটওয়াকিং এর মাধ্যমে তার কানেকশন ছিল যথেষ্ট স্ট্রং। সোমেরা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পরই তাদের বন্ধু সারকেল ভেঙে যায় । কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ ডাক্তারি আবার কেউবা ভালো ভালো কলেজে অনার্স নিয়ে এদিক ওদিক ছিটকে যায়। তখন তাদের যোগাযোগের মাধ্যম তখন সোশ্যাল মিডিয়া আর বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। অন্যান্য ছুটিতে তারা সকলে একজোট বাঁধতে না পারলেও দুর্গা পূজার ছুটিতে সবাই বাড়ি আসতো। তখনই তাদের একে অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হত গল্প-আড্ডায় ঠাকুর দেখা, খাওয়া দাওয়া , মুভি দেখা এইসবের মধ্যদিয়েই পাঁচদিন দারুণ এনজয় করে কাটতো।
সোমের বেস্ট ফ্রেন্ড রাহুল ।সোম দের পাড়াতেই থাকে। রাহুল বরাবরই পড়াশোনা বেশ মেধাবী ।সে উচ্চ মাধ্যমিক এর পর কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়। প্রীতম ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পায় মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে। সুচন্দ্রা ফিজিক্স অনার্স নিয়ে কলকাতাতেই নামি কলেজে ভর্তি হয়। দেব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়। রিমি বরাবরই নাচ টাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। তাই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। দুর্গাপূজার একমাস আগে থেকেই তারা গ্রুপ চ্যাট এ পূজার পাঁচ দিনের প্ল্যান করে রাখতো। সেই মতো তারা এনজয় করত।
বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। সোম তখন এম কম সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো। সেই বছরও দূর্গা পূজার ছুটিতে সে বাড়িতে এসেছিল। সোহিনী তখন বি এ ফাস্ট ইয়ারের ছাত্রী। বয়স উনিশ বছর। দুজনে একই পাড়াতে থাকলেও কেউই কাউকে চিনত না। চিনলেই বা কি করে সোহিনী বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোত না। খুব ই লাজুক, ও চুপচাপ স্বভাবের। সারাদিন স্কুল, টিউশান গানের স্কুল নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসতো। বন্ধু বান্ধব দের সাথেও খুব একটা মিশত না। তাছাড়া সোম বয়সে সহিনীর থেকে বছর পাঁচেক এর বড়। তাই তাদের আগে থেকে না দেখা হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
চলবে---
ছবি : নিজস্ব
0 মন্তব্যসমূহ