অষ্টমীর অঞ্জলি ( দ্বিতীয় পর্ব)
সোহিনীর গোমরা স্বভাবের জন্যই স্কুল লাইফের কোন ছেলে মেয়েরা তার সাথে মিশত না। কিন্তু তা বলে সোহিনী কিন্তু দাম্ভিক ছিল না । ও ছোট থেকেই নিজের মত থাকতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। মা বাবার উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। সহিনীর মা প্রভা দেবী যে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন সেই স্কুলেই ও ভর্তি হয়েছিল। তাই মায়ের সাথেই স্কুল যাতায়াত করতো। আর হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সহিনীর বাবা রজত বাবু অফিস যাবার পথে মেয়েকে ছেড়ে আসতেন স্কুলে। আর সহিনীর স্কুল শেষ হয়ে গেলে তাকে নিয়ে আসতে যেতেন প্রভা দেবী। সোহিনীর জগৎ ছিল পুরোপুরি পরিবারকেন্দ্রিক। স্কুলের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, হৈ-হুল্লোড় করার যে একটা আলাদাই অনুভূতি সেটা থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিল। এক কথায় যাকে বলে ঘরকুনো। ওই স্কুল, টিউশান এ ছাড়া বাইরের জগতের সাথে তার কোনো সখ্যতা ছিল না বললেই চলে।
কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর সহিনীর মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। সদ্য উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট আউট হওয়ার পরই নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য ফর্ম ফিলাপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সময় রাজতবাবুর অফিসের চাপ থাকায় সোহিনি একাই বের হয় কলেজের ফরম তুলতে। সেই সময় ট্রেনের জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকলে সেই প্রথমই কেয়ার সাথে সহিনীর কথা হয়। কেয়া আর সোহিনী একই পাড়াতেই থাকে। দুজনে একই স্কুলে একই ক্লাসেই পড়তো। তারা প্রথম থেকেই দুজন দুজনের নাম জানলেও কথা বলত না।
কেয়া র বরাবরই বন্ধুর সংখ্যা অজস্র। আগের ট্রেন টা মিস হয়ে যাওয়ায় ও দলছুট হয়ে গেছে। কেয়া একদম চুপচাপ থাকতে পারে না। তাই সহিনীকে স্টেশনে একাকী দেখে কথা বলবে কি বলবে না ভেবে ইতস্তত হয়ে নিজে থেকেই কথা বলতে আসে। সোহিনী যেহেতু অহংকারী নয় , তার সাথে কেয়া কথা বলতে আসলে সেও ভালোভাবে কথা বলে । তখন থেকেই কেয়া আর সোহিনীর মধ্যে
ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । তারপর আস্তে আসতে ফোন নম্বর আদান-প্রদান একই কলেজে পড়াশোনা সব জোরকদমে এগিয়ে চলে। সদাহাস্যময়ী, প্রাণচাঞ্চল কেয়ার দৌলতে সোহিনী এক নতুন জগতে প্রবেশ করে ।
কলেজ লাইফে প্রবেশের পর বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা বাড়তে থাকে সহিনীর। সে একাকীত্ব থেকে মুক্তির স্বাদ পায়। আগে দুর্গাপূজার সময় মা-বাবা ও বোনের সাথে শুধু ঠাকুর দেখতে বের হতো সোহিনী। এখন বাইরে পরিবেশে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, পড়তে যাওয়া, ক্লাস ব্যাংক করে ফুচকা খাওয়া, সিনেমায় যাওয়া, এই গুলো বেশ উপভোগ করে সোহিনী। তাছাড়া বান্ধবীদের দেখে , স্মার্টফোনে দৌলতে ঘরোয়া চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজেকে পরিবর্তন করে নিয়েছে সে। কেয়া ছাড়াও রিম্পা, নবনীতা, আর্য্য, পার্থ, শিমন্তী অঙ্কন সব মিলিয়ে তাদের ছিল আট জনের হুল্লোড়ে দল। কলেজের প্রথম বর্ষ থেকেই তারা চুটিয়ে কলেজ লাইফটাকে এনজয় করেছে। সামনে দুর্গা পুজো আট জন মিলে অনেক প্ল্যান করল পুজোয় কোন দিন কোন দিকে ঠাকুর দেখতে বেরোবে, কোন দিন কোন ড্রেস পড়বে, কোন রেস্তোরাঁয় পেটপুজো করবে সেইসব।
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেই এখন আর হারমোনিয়াম নিয়ে সহিনীকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় না। কারণ পুজো আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা দিন বাকি। সোহিনী এখন রূপচর্চা, চুলের যত্ন ,ডায়েট এইসব নিয়েই খুব বিজি। সহিনীর এইরকম আমূল পরিবর্তন রজত বাবু ও প্রভাদেবীরও দৃষ্টি এড়ালো না। তবে তারা মনে মনে বেশ খুশি হলেন কারণ তাদের মনে ভয় ছিলো কলেজ লাইফ এ নতুন পরিবেশে সোহিনী আদেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা।সহিনীর এইরূপ পরিবর্তনে রজত বাবু খুশি হয়ে বললেন মেয়েরা এই বয়সে সাজবে না তো আর কোন বয়সে সাজবে? অবশ্য সাজগোজ সব বয়সেই করা যায়। কি বলো প্রভা?এটা তো একটা আর্ট তাই তো ? ঠিক বলছি তো আমি? প্রভা দেবী মুচকি হেসে রজত বাবুর কথায় সায় দিলেন।
সেই বছরই সোহিনী প্রথম মা বাবা ছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোল। অবশ্য এতে তার মা-বাবার অনুমতি ছিল । প্রথম দিনই অর্থাৎ ষষ্ঠীর দিনই তারা দিনের বেলা লাইন দিয়ে নর্থ কলকাতায় অনেক ঠাকুর দেখলো। ভালো রেস্তোরাঁয় হইহই করে পেট পুজো করলো। এত আনন্দ এত খুশি যেন সোহিনী আগে কোন পুজোতেই উপভোগ করে নি। আসলে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্পআড্ডায় পুজো কাটানোর মজা টাই আলাদা। কিন্তু দুঃখের বিষয় সপ্তমীর দিন শরীরটা একটু খারাপ থাকায় সোহিনী আর বেরোতে পারল না। রিম্পা রাতের দিকে সহিনীকে মেসেজ করে লিখেছিল ওই জন্যই বলে প্রথম থেকেই বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে থাকতে হয় । একটু রোদে রোদে ঘুরতেই অমনি শরীর খারাপ হয়ে গেল। গেলি তো পুরো মিস করে সপ্তমীর আড্ডাটা।আর্য্য অবশ্য ফোন করে বলেছিল চিন্তা করিস না ঠিক হয়ে যাবে। আশা করছি আবার অষ্টমীর দিন ইনজয় করতে পারবি । রিমপার কথায় অবশ্যই কিছু মনে করেনি সোহিনী। ও এখন জানে বন্ধুদের মধ্যে একটু ঠেস দিয়ে কথা চলতেই পারে। সপ্তমীর দিন রাতেই কেয়া ফোন করে বলল সকাল আটটার মধ্যে রেডি থাকিস । একসাথে অঞ্জলি দিতে যাব । যথারীতি অষ্টমীর দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে লাল সাদা জামদানি শাড়ি পড়ে বাহারি গয়নায় নিজেকে সম্পুর্ন সাবেকিয়ানা সাজিয়ে সোহিনী উপস্থিত হল পাড়ার পূজা মন্ডপে । কেয়া আর সোহিনী এখানেই অঞ্জলি দেবে। কিন্তু সোহিনী টাইম মতো পূজামণ্ডপে উপস্থিত হলেও কেয়া তখন ও এসে পৌঁছায় নি।অগত্যা সোহিনী কেয়া কে ফোন করতে ওবললো দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে। তাই সোহিনী পুজো মণ্ডপের ভিতর একটি চেয়ার নিয়ে বসলো।ও লক্ষ্য করলো মণ্ডপের এক কোনে একদল ছেলেরা মিলে চেয়ারে বসে গোল করে আড্ডার আসর বসিয়েছে। সেখানেই সোমের সাথে সহিনীর প্রথম দেখা।
চলবে--( ভালো লাগলে বন্ধুরা কমেন্ট করবেন। অবশ্যই শেয়ার করবেন।)
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ