একটি মেয়ের স্বপ্ন

 

A girl's dream



একটি মেয়ের স্বপ্ন

ইরার যখন বয়স মাত্র তিন বছর, তখনই তার বাবা একটি রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। তপন সরকার মানে ইরার বাবা ছিলেন একজন লরির ড্রাইভার। লরিটা অবশ্য তাঁর নিজের ছিল না। মালিকের গাড়ি ভাড়া নিয়ে চালাতেন। তাই তপনবাবুর এই অকাল প্রয়াণে ইরার মায়ের অবস্থা তখন খুবই শোচনীয়।ইরার মা নিশা দেবী পড়াশোনা বিশেষ  করে নি। তাই তার পক্ষে কাজ পাওয়াটা অতটা সোজা ছিল না। একদিকে অভাব-অনটন, অন্যদিকে ছোট্ট ইরার মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার চিন্তায় দিনরাত্রি কাজের সন্ধানে ঘুরত নিশা। এইভাবে সে দুটো বাড়িতে রান্না করার কাজও পেয়ে যায়। সকালবেলাতেই সে যেত রায়েদের বাড়ি রান্নার কাজএ।  রায় বাবু সকাল নয়টার মধ্যে অফিসে  বেরোতেন। তাই ওদের বাড়ির রান্না করতেই নিশাকে আগে যেতে হত। রায় গিন্নিমা মহিলাটি খুবই বিনয়ী ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। তিনি নিশা দেবীর কষ্টটা বুঝতেন । তাই নিশা যখন অনাজ কাটা, বাটনা বাটা,  রান্নায় ব্যস্ত থাকত,  তখন রায় গিন্নি মা  ছোট ইরা কে নানা রকম খেলা দিয়ে তার পাশেই বসে থাকতেন। পাছে ইরা যাতে পরে টরে না যায়। রায় গিন্নিমার পায়ে বাতের ব্যথা জন্য  ডাক্তার তাকে সব  কাজ করতে বারণ করেছেন । তাই তার এই অবসরে ইরাকে পাশে পেয়ে তাঁর ভালোই লাগতো।

 বেলা দশটার মধ্যে রায় বাড়ির কাজ শেষ করে নিশা চলে যেত ঘোষে দের বাড়ি।  কিন্তু ইরা থেকে যেত রায় গিন্নি মার কাছেই। নিশা  প্রতিদিন ঘোষ বাড়ির কাজ শেষ করে তারপর ইরা কে নিয়ে বাড়ি ফিরত। রায় গিন্নি মার  কাছে  ইরা থাকত বলে নিশার কাজের কোনো অসুবিধা হতো না। সে নিশ্চিন্তে  কাজ করতে পারতো।দু বাড়ি কাজ করে যা মাহিনা  পেত তাতে মা মেয়ের টেনেটুনে কোনো মতে চলে যেত। তাছাড়া সকালবেলা থেকে দুটো টাইম ইরা রায় গিন্নি  মায়ের কাছেই খেয়ে নিত। সুতরাং মা মেয়ের সংসার বেশ  সুখ এর ই ছিল ।এভাবেই কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর। ইরা একটু বড় হতেই তাকে  সে ভর্তি করে দিল স্থানীয়  একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে।

 কিন্তু এই সুখ টা কে নিশা বেশি দিন ধরে রাখতে পারল না। তার জীবনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছিল। নিশা সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি। আর একটু সুখ ও স্বামী সোহাগের আশায় দুশ্চরিত্র মোহনের টোপে পা দিল নিশা । তবে নিশা প্রথমে জানতো না মোহনের  ওই ঘৃণ্য গুণের কথা। রায়বাড়ি থেকে কাজ সেরে ঘোষ বাড়ি যাওয়ার পথেই  মোহনকে প্রথম দেখে নিশা। মোহন ই  তার সাথে যেচে যেচে  খেজুরে আলাপ করতে আসত। প্রথম দিকে নিশা তাকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু মোহন যেদিন নিশার রাস্তা আটকে বলেছিল-- জানি তুমি একজন বিধবা। তোমার একটি ছোট বাচ্চা ও আছে। তুমি লোকের বাড়ি রান্না করে সংসার চালাও। সব জেনেও আমি তোমায় বিয়ে করতে রাজি আছি। আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করি। তাতে তিনটে পেট ভালোভাবে চলে যাবে। আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি নিশা। তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমায় খুব সুখে রাখবো নিশা। মোহনের মুখ থেকে  এ কথা শুনে নিশা সেদিন  কিছু না বলেই কাজে চলে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন সে কাজে ঠিক মত মন দিতে পারছিল না। তাই ডালে নুন দিতেও ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু বদরাগী ঘোষগিন্নি সেদিন কোনো কথা  শোনায় নি নিশা কে।  তিনিও  নিশার মুখে দেখেছিলেন চিন্তার ছাপ। 

 সেদিন বাড়ি ফিরে নিশা  সারারাত ঘুমোতে পারল না। শুধু মোহনের বলা কথা গুলো  তার কানে বাজতে লাগল। সারারাত ধরে নিশা ভাবল সে যদি মোহন কে  বিয়ে করে তাহলে সে ইরাকে আর একটু স্বাচ্ছন্দে রাখতে পারবে।  ও হয়তো আরেকটু সুখে থাকতে পারবে। তাছাড়া তখন কতই বা বয়স নিশার । হয়তো স্বামীর সুখ ও মনে মনে পেতে চেয়েছিল সে। 

 পরের দিনই নিশা রায় গিন্নি মাকে মোহন এর ব্যাপারে সবকিছু জানায়।  তা শুনে  গিন্নি মা বলেন--  মোহন  যদি সত্যিই তোকে ভালবাসে তাহলে বিয়ে করে সুখে থাক তোরা। ভালই হল ইরা  একটা বাবা পাবে । তবে তোর কথা আমার খুব মনে পরবে রে নিশা।তোর মেয়েটার কথা ও। বিয়ের পর তো তুই আর কাজ করতে আসবি  না।
  আমি তোমার সব রান্নার কাজ করে দিয়ে যাব গিন্নি মা বিয়ের পরেও। আর ইরাও তোমার সাথে এসে দেখা করে যাবে। আমি  মোহন কে সে কথা বলেই বিয়ে করব। যা ভালো বুঝিস। ঠিক আছে গিন্নিমা তোমায় ওই নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না। চললাম গো।

কিন্তু মোহনকে  বিয়ে করার পর নিশার জীবনে কোনো রকম উন্নতি ই হয়নি। বরঞ্চ তার জীবনের চরম অন্ধকার নেমে আসে। প্রথম প্রথম কয়েকমাস ভালোভাবে কাটলেও  কিছুদিন পরেই মোহনের আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে। প্রতি রাতেই মোহন মদ  খেয়ে তাকে অকথ্য গালিগালাজ দেয়, মারধর করে। কিন্তু তার কোনো প্রতিবাদ না করে মুখ বুজে সব সহ্য করে নিশা।নিশার উপার্জনের টাকাও কেড়ে নিয়ে মদ, জুয়া খেলতো সে।  ধীরে ধীরে ইরার  স্কুলে যাওয়া টাও বন্ধ করে দেয় মোহন। ইতিমধ্যেই ইরার যখন  মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স নিশাও ইরার চূড়ান্ত আপত্তি সত্ত্বেও  মোহন বিয়ে দিয়ে দেয় ইরার  একটা লম্পট মাতালের সাথে। নিশার সাথে সাথেই ইরার ভবিষ্যৎও নষ্ট হয়ে যায়। কম বয়স য়েই ইরা গর্ভবতী হয়ে পরে। শুরু হয় নিশার মতোই ইরার ওপর অত্যাচার। সন্তানসম্ভবা অবস্থাতেও তার ঠিকমত খাওয়া জোটে না। কোনরকম আধপেটা খেয়েই   অবহেলা , অনাহারেই সে জন্ম দেয় এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান  এর। কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায়  এই অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।

 ইরা নিজের সন্তানকে ও নিজেকে বাঁচাতে আর স্বামীর কাছে থাকে নি। ইরা তার মা নিশার মতো পরে পরে সমস্ত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে চায়নি। তার জীবনে অনেক টাই মূল্যবান সময় তার সৎ বাবা মোহন ও লম্পট  স্বামীর জন্য নষ্ট হয়ে গেছে। তাই নিজের সন্তানকে বাঁচাতে সে নিজেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।  ইরা এখন  ভোর বেলায় শহর থেকে ফুল কিনে এনে বাজারে বিক্রি করে। ও কাউকে এখন বিশ্বাস করে না। ছোট্ট মেয়েকে সাথে নিয়েই সে জীবন সংগ্রামে লড়াই করছে। এখন  সে স্বাবলম্বী । কারো সাহায্য ছাড়াই নিজের চেষ্টায় সে তার মেয়েকে বড়ো করবে। মানুষের মত মানুষ করবে। এটাই তার এখন একমাত্র স্বপ্ন ও লক্ষ্য।


  ছবি : সংগৃহীত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ