সাইকো
মোটামুটি একটা মাস লেগেছিল রিনার, নিজেকে সামলাতে। নিলয়ের সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়াটা ও ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু একসাথে থেকেও দিনের পর দিন অশান্তি, মারধর অত্যাচার এটাও সে অবলীলায় মানতে নারাজ ছিল। তাই ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা সেই প্রথম নিয়েছিল। না !!! নিলয় কোনো পরোমহিলায় আসক্ত, কিংবা মাদকাসক্ত ছিল না । আসলে তাদের মতের কোনো মিল হত না। সাংসারিক জীবনে খুঁটিনাটি ব্যাপারে সবসময় মতের মিল নাই থাকতে পারে । কিন্তু ছোটখাটো ব্যাপারও নিলয় নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারত না। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এমন কি মারধর করতো রিনাকে।
নিলয় আর রিনার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। রীতিমতো খবরের কাগজ দেখে সন্মন্ধ করে বিবাহ হয় তাদের । নিলয় একটি নামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মচারী। দেখতে মোটামুটি চলনসই । চেহারায় হাইফাই চেকনাই না থাকলেও উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি হাইট। এখনকার জেনারেশন স্টাইলিস্ট পুরুষদের যেমন দেখতে তেমন ই। নির্ঝঞ্ঝাট মা ছেলের ছোট পরিবার দেখেই রিনার বাবা-মা বিয়েতে খুব সহজেই রাজি হয়েছিলেন। অবশ্যই রিনার মতামত নিয়েই তারা এই বিবাহের দিন ঠিক করেছিলেন।
রিনাও দেখতে আহামরি সুন্দরী না হলেও অতীব ফর্সা, মাঝারি গড়ন এবং সুশিক্ষিতা ও সুগায়িকা । নিলয়ের মায়ের ও রিনাকে পছন্দ হয়েছিল। তাই দেখাশোনা মেটবার পাক্কা তিন মাসের মাথাতেই তাদের সামাজিক এবং অফিশিয়াল দুই বিবাহই সম্পন্ন হয়েছিল। বিয়ের আগে কথাবার্তা , মেলামেশার সুযোগ খুব একটা তারা পায়নি। যতটুকু কথা হতো ওই ফোনেই। আর বিয়ের আগে মাত্র দুইবার তারা দেখা করেছিল রেস্তোরাঁয়।
বিয়ের পরপরই রিনা নিলয়ের অদ্ভুত চরিত্রের সন্ধান পায়। সে লক্ষ্য করে নিলয় একটুতেই সাধারণ ব্যাপারে ও খুবই ওভার রিয়াক্ট করে। নিলয়কে অফিস বেরোতে হয় সকাল সাতটায় । সদ্য বিবাহিতা রিনাকে তাই ভোরবেলাতেই ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ বক্স এর জন্য খাবার তৈরি করতে হতো। একদিন টাইম মতো রান্না না হওয়ার জন্য নিলয় রাগ করে পরপর সাতদিন টিফিন নিয়ে গেল না। রিনা রান্না করে লাঞ্চ বক্স রেডি করে ব্যাগে ভরে দিলেও তা ব্যাগ থেকে বের করে রেখে অফিস যেত। সদ্যবিবাহিতা রিনা ভাবতেই পারেনি মাত্র একদিনের জন্য এত বাড়াবাড়ি করবে নিলয়। এমনকি রাতে অফিস থেকে ফিরে ঠিকমতো কথাও বলতো না। নিলয়ের মা অনিমা দেবী সবই দেখতেন। রিনাকে বলতেন নিলয় বরাবরই এইরকমই স্বভাবের। আমি ও ওর সাথে তাই বুঝে শুনে কথা বলি। অনিমা দেবী রিনাকেও বলতেন একটু মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই টুকিটাকি সাধারণ ব্যাপারে মেজাজ হারিয়ে নিলয়ের চিৎকার রিনারএকদম সহ্য হত না।
রিনার শ্বশুর বাড়ির এলাকায় প্রতিবছর জৈষ্ঠ্য মাসের কালীপুজো হয়। বিয়ের পর প্রথম কালি পুজো। রিনার ইচ্ছা ছিল নিলয় অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে একসাথে ঠাকুর দেখতে বেরোবে । সেইমত লাঞ্চ টাইমে রিনা ফোন করে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার কথা বললে নিলয় স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তার ইচ্ছা নেই অফিস শেষে ঠাকুর দেখতে যেতে। রিনা যেন একাই ঠাকুর দেখতে চলে যায়। সদ্যবিবাহিত রিনার মনে খুব কষ্ট হয়। অচেনা একটা পাড়ায় নতুন বউ হয়ে একা ঠাকুর দেখতে যেতে তার ও মন চায় না। ঐদিকে অনিমা দেবীও দুঃখ করে বলেন রিনাকে সে যদি চলতে হাটতে ঠিক মতো পারতো সেই নিয়ে যেত। আসলে অনিমা দেবী বাতের রুগী। তাই রিনা না গিয়ে বাড়িতেই থাকে। ওদিকে নীলয় অফিস থেকে এসে দেখে রিনা ঠাকুর দেখতে যায়নি। তাই নিয়ে গন্ডগোল করে গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে ছাড়ল না সেদিন। নিলয়ের বক্তব্য অনুযায়ী নিজের যেটা ইচ্ছা থাকে সেটা একাই পূরণ করতে হয়। কারো বিরোহে কেউ থেমে থাকেনা। সে এই কথায় আরো কষ্ট পায়। নিলয়ের মুখের ওপর কাঁদতে কাঁদতে সে শুধু বলেছিল আমার একা যেতে ইচ্ছে হয়নি তাই যাই নি। এই সামান্য কথা টুকুও মুখে মুখে তর্ক করা করা হচ্ছে বলে আরো এক ঘা মারে রিনাকে। রিনা বুঝতে পারে নিলয় খুবই গরম মেজাজের মানুষ। তবে রাগ কমলে রিনাকে ভালোবেসে ভালোভাবে বোঝাতে চায় তার কাজের প্রেসার থাকলে সে যেন একাই ঘুরে আসতে পারে তার পছন্দমতো শপিং মল রেস্তোরাঁয় যেখানে খুশি। কিংবা কোন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ও।সেটুকু স্বাধীনতা সে পাবে। এমনকি রিনাকে বলে তুমি শিক্ষিতা যদি তোমার ইচ্ছে তুমি চাকরি ও করতে পারো। রিনা ভাবে এই সব দিক থেকে স্বাধীনচেতা নিলয় ঠিক ই আদর্শবান মানুষ। কিন্তু সামান্য ব্যাপারে ওভার রিয়াক্ট যখন করে নিলয় তখন সেই নিলয় কে যেন এক ঝটকায় বড়ই অদ্ভুত লাগে রিনার। বিয়ের এক মাস পার হতে না হতেই নিলয় ওর গায়ে হাত দেয় মারধোর করে সে কথা সে বাবা-মা কে বলতে পারেনা। বাবা-মায়ের খারাপ লাগবে ভেবে কিন্তু রিনা মনে মনে প্রায়ই ভাবে তাদের মধ্যে এখনও তৃতীয় প্রাণের সঞ্চার ঘটেনি ।সারাটা জীবন এই রকম সাইকো মানুষের সাথে নিজের জীবনটা জড়িয়ে বিপন্নতার মধ্যে না কাটিয়ে ডিভোর্স নিয়ে আলাদা থাকাই শ্রেয়।
এইভাবে কখনো ভালোবাসা কখনো পারিবারিক চূড়ান্ত অশান্তির মধ্যে আরও ছয় মাস রিনা নিজেকে এই সংসারে আবদ্ধ রেখে নিলোয় এর চরিত্র শোধরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। উল্টো রিনা মানসিকভাবে আরো ভেঙে পড়েছিল। তাই শেষমেশ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত সেই নিয়েছিল। কিছু দিন আগে অফিস থেকে ফিরতে নিলয় খাবার টেবিলে বসে রিনাকে রান্না খারাপ হওয়ার জন্য যা নয় তা বলে অপমান করছিল এমনকি তার বাপের বাড়ির কথা তুলেও তাকে অপমান করে। রাগের মাথায় রিনা তখন বলেছিল এই সংসারে সেও আর থাকতে চায়না। ডিভোর্স চায়। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয় নিলয়ও তাতে একবার ও আপত্তি না করে কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স পেপার রেডি করে সই করে রিনাকে মুক্তি দেয়।
প্রথম প্রথম রিনার এটা মানতে কষ্ট হয়েছিল। হাজার হোক মেয়েরা বিয়ে নিয়ে,একটা সুন্দর সংসার নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। তাই সদ্য বিয়ে ভেঙে যাওয়াতে আঘাত পেয়েছিল। ওদিকে নিলয় তার চরিত্রের কোনো পরিবর্তন করে নি। উল্টে রিনার কোথায় জেদ বশত ডিভোর্সও দিলো ।এক মাস পর সেই ডিভোর্সের মায়া কাটিয়ে রিনা আগের থেকে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক এবং সুস্থ । মনে মনে এখন ভাবে ভাগ্যিস হ।সাইকো টা ডিভোর্স দিতে আবার নাছোড়বান্দা করে নি, না হলে সারাটা জীবন তাকে একটা ভুল মানুষের সাথেই জীবন অতিবাহিত করতে হত।
ছবি : সংগৃহীত
0 মন্তব্যসমূহ