স্বাবলম্বী
ভোরের আলো ফোটার আগেই রাধারানী বেরিয়ে পড়ে জীবিকার তাগিদে। ভোর সাড়ে তিনটের মধ্যেই তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর কুড়ি মিনিট হেঁটে স্টেশনে পৌঁছায়।ট্রেন সেই সাড়ে চারটে তে । রাধারানী ফুলের ব্যবসা করে।সে প্রতিদিন হাওড়া থেকে ফুল নিয়ে এসে সাত্ টার ট্রেনে আবার ফিরে আসে এই মানিকগঞ্জে।সেখানে সে রঘুনাথের চপের দোকানে বসে ফুল বিক্রি করে। রঘুনাথের চপের দোকান টা অবশ্য আর নেই। রঘুনাথ ই বেঁচে নেই তো আর ওর চপের দোকান । রঘুনাথ ছিল রাধারাণীই স্বামী। সে চপ বিক্রয় সবগুলো টাকা নিয়েই প্রতি রাতেই ওই বাজারের ফুলির কাছে চলে যেত। তারপর সেখানে সর্বস্ব বিকিয়ে মদ খেয়ে টলতে টলতে ঘরে ঢুকে সে রাধারানী কি গালিগালাজ টাই না দিত।
আর মারধোর তো লেগেই থাকত। সহ্য করতে না পেরে রাধারানী তার ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে প্রায়ই বাপের বাড়ি চলে আসতো । প্রায় দিনই ওদের হারি চাপতো না , সমস্ত টাকাই ফুলি কে দিয়ে সকালবেলায় রাধারাণী কে টাকা চুরির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করত।
তার এই দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বিশুদা। মাঝে মাঝে তাদের সংসারে কিছু চাল, আটা, ডাল দিয়ে সাহায্য করত সে বিশু দা ছিল রঘুনাথেরই বন্ধু। তার একটি রেশনের ডিলার ছিল। রাধারানী প্রথমে বোঝেনি বিশুর আসল উদ্দেশ্য । কিন্তু বুঝতে তার বেশি দিন সময় লাগে নি অবশ্য।সে লক্ষ করতো বিশু দা তাদের বাড়ি এলেই রাধারানী শরীরের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত। কয়েকবার সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু রাধারানী নিজে ঠিক মতো সামলে নিয়েছিল নিজে কে।
এদিকে অত্যাধিক মদ খাওয়ার তারণায় রঘুনাথ হঠাত ই হার্ট অ্যাটাক করে না ফেরার ঠিকানায় চলে যায় ।ছোট দুটো মেয়েকে নিয়ে সদ্য বিধবা রাধারানী অথৈ জল এসে পড়ে। আর এই অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল বিশু। সে রাধারাণী কে নিয়ে আবার নতুন ঘর বাঁধার আশাস দেয়। রাধারানীও তখন নিজেকে সামলাতে পারেনি কারণ মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। তখন তার বড়ো মেয়ের বয়স বারো। ছোট মেয়ের সাত। বড় মেয়ে তৃষা প্রথম দিকে কিন্তু বিশু কাকা কে বাবা বলে মানতে নারাজ ছিল। মাস দুয়েকের মধ্যেই বিশু মেয়েদের মধ্যে অদ্ভুত ভালোবাসা দিয়ে তাদের মন জয় করে নিল ।
তারা তখন কেউ ই টের পায়নি বিশুর মধ্যে কতটা বিশের বীজ বপন হয়েছে। একদিন রাধারানী জল আনতে রাস্তার কলে লাইনে দাঁড়িয়েছিল। সকাল বেলার দিকে এই সময়টা কলে ভীড় টাও বেশি থাকে। বিশু রাধারানীর অনুপস্থিতির সুযোগে ঘরে ঢুকে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে তৃষা ঘরের মধ্যে এক মনে পড়াশোনা করছে ।তাকে একা পেয়ে তার উপর সে তার পৈশাচিক অত্যাচার শুরু করে। মাত্র বারো বছরের এক কিশোরীর উপর তার লালসার বিষ নিয়ে তার ওপরে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে । তখন তৃষা প্রাণপণে চিৎকার করতে গেলেও তার মুখটা চেপে রাখে বিশু। ফলে চিৎকার এর পরিবর্তে একটা চাপা গোঙানি শুধু বেরিয়ে আসতে থাকে তার মুখ দিয়ে । বিছানায় পড়ে এইভাবে যখন বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টায় মরিয়া তৃষা হাতের পাশে বিছানার কাছে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে রাখা রঘুনাথের চপ ভাজার বড় লোহার খুন্তি টা সে পেয়ে যায়। তারপর নিজের বাবাকে স্মরণ করে গায়ের জোরে খুন্তিটা দিয়ে মারে ঝনাত করে বিশুর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে বিছানা রক্তে লাল হয়ে যায় ।আর তৃষা ছুটতে ছুটতে মায়ের কাছে এসে সবকিছু বলে দেয়। পাড়া প্রতিবেশীরা তখন সবাই সেখানেই ছিল বলে আহত বিশু বেশিদূর পালাতে পারেনি । তাকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ঘরে এসে সব বৃত্তান্ত শুনে রাধারানী শুধু এটুকুই ভাবে অভাবের সংসারের রঘুনাথ বেঁচে না থাকলেও মেয়েকে তার কলঙ্কের হাত থেকে সেই বাঁচিয়েছে। আজ রাধারানী ফুল ব্যবসায়ী ।সে স্বাবলম্বী। সে আর কারোর দয়ায় বাঁচে না। রঘুনাথের চপের দোকান টা তেই ফুল বেচে সংসার চালায় । ভালো আছে রাধারানী বড় হচ্ছে তৃষা আর ওর ছোটবোন নির্দ্বিধায় মায়ের ছত্রছায়ায়।

0 মন্তব্যসমূহ