কন্যা সন্তান দেবীর স্বরূপ
ফোনের রিং টোন টা বেজে উঠতেই সুলচনাদেবী রিসিভ করেই ও প্রান্ত থেকে কিছু বলে ওঠার আগেই নিজেই বলে চললেন-
-- হ্যাঁ রে, কি খবর রে? ডাক্তাররা সব আছেন তো এত রাতে? কতো বার বললাম টুকাই তুই আমাকেও নিয়ে চল। কোনো কথাই শুনলি না। এই রাতদুপুরে এমন অবস্থায় আমার আর তোর বাবার আরো তো উৎকণ্ঠা হচ্ছে। বৌমা ঠিক আছে তো?
--হ্যাঁ মা, ওতো টেনশন করো না। ডাক্তাররা সবাই আছেন। যন্ত্রণাটা বেশি হচ্ছিল। ডাক্তারবাবু মৌকে এইমাত্র ইনজেকশন করেছে। ইমারজেন্সি তো। তাই ডাক্তাররা বললেন এক্ষুণি সিজার করতে হবে।
-- আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওনারা যা ভালো বুঝবে করুন। ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক। হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করিস কিন্তু। এদিকে আমি আর তোর বাবা খুব চিন্তায় আছি কিনতু।যতক্ষন না কোনো সুখবর পাচ্ছি।
অতঃপর, ফোনটা কেটে দিয়ে টুকাই নার্সিংহোমে ওয়েটিং রুমে বসে থাকে অধীর আগ্রহ, আর মৌ এর জন্য একরাশ চিন্তা নিয়ে।
মৌ হলো টুকাই এর স্ত্রী। বরাবরই সে একটুতেই আলকাতুড়ে, ভীতু প্রকৃতির।
অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরই তারমধ্যে এই ভীতু ভাবটা আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। এমনকি আজ ও হটাৎ যন্ত্রনা ওঠার সময়ও অস্বাভাবিক রকম ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। নার্সিংহোমে নার্সরা কিছুক্ষন আগে যখন ওকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যায় ওর মুখটা আরো যেন ফ্যাকাসে, বিবর্ণ লাগছিলো। তা অবশ্য এইসময় সব মেয়ে দেরই এমনটা লাগে। এতে টুকাই এরও যে কোনো অংশে ভয় কম করছিল তা নয়। একদিকে প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে মৌ এর মানসিক অবস্থার এই অবনতি- এই দুইয়ের সংঘাতে তারও বুকটা যেন ধকধক করছিল। নার্সিংহোমে নিয়ে আসার পথে মৌকে অনেক সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছিল টুকাই। কিন্তু কোনো যুক্তিই মৌ এর কাছে ধোপে টেকে নি। তার বক্তব্য " তুমি এইসব কষ্ট, ভয় কোনো কিছুই বুঝবে না। মেয়ে হলে বুঝতে। আমার যদি কিছু হয়ে যায় ভালো মন্দ যে আসছে তাকে আগলে রাখবে তো সারাজীবন? টুকাই কথা দাও।" - কি যে হাবি জাবি অলুক্ষনে কথা বলে মেয়েটা- এইসব কথাগুলো এই মুহূর্তে টুকাই কে আরো বিচলিত করছিল। এমন ই সময়- সিস্টার এর গলা- কংগ্রাচুলেসন, মিস্টার সেনগুপ্ত। বেবি হয়ে গেছে। বাচ্চা, এবং মা দুজনেই সুস্থ আছে। আপনার কন্যা সন্তান হয়েছে।
প্রথম বাবা হওয়ার এই আনন্দ সে নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারছিল না। খুশিতে চোখের কোণ চিকচিক করে উঠলো। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফোন করতে গিয়েও কেমন যেন থমকে গেল টুকাই। মনে মনে ভাবল - কন্যা সন্তান হওয়ার খবরটা মা, বাবা ভালো ভাবে নেবে তো।আমার তো কোনো বোন কিংবা দিদি নেই। তাই একটা মেয়ের কদর তারা বুঝবে কি?এইসব আকাশকুসুম ভেবেচিন্তে খানিকটা ইতস্তত করে ফোনটা করলো বাড়িতে।
--হ্যালো
--হ্যাঁ, টুকাই শুনতে পাচ্ছি বল। বল বাবা , আর টেনশন এ রাখিস না আমাদের।
--মা, বলছি, ইয়ে... মানে-
-- কি তখন থেকে ইয়ে ইয়ে করছিস বল না তাড়াতাড়ি। ওরকম করছিস কেন? টুকাই রে, মৌ ঠিক আছে তো?
--হ্যাঁ, ও ঠিক আছে। মানে মেয়ে হয়েছে।
-- আঁ সে কি রে!! বলেই সুলচনা দেবী সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। পাশে থাকা সুলচনা দেবীর স্বামী অমলবাবু আর থাকতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো।- কি হলো গো? ওরকম হা করে আছো কেন? কি হয়েছে? বাককিহারা সুলচনা দেবীর থেকে কোন উত্তরের আশা না করেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন টা কেড়ে নিয়ে টাকাই কে ফের জিজ্ঞাসা করলো-- কি হয়েছে টুকাই? বাচ্চা, মা দুজনেই সুস্থ আছে তো?
--হ্যাঁ বাবা, সুস্থ আছে। ভালো আছে। বাবা, আমার মেয়ে হয়েছে।
খবর টা শোনা মাত্রই অমল বাবু খুশিতে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না ।সুলচনা দেবীকে জড়িয়ে ধরে উচ্চ স্বরে বলতে থাকলেন, - আজ আমার পরম খুশির দিন সুলচনা। দীর্ঘ বত্রিশটা বছর অপেক্ষা করিয়ে মা লক্ষ্মী এলেন আমার ঘরে।
আমরা কত আশায় বুক বেঁধেছিলাম আমাদের একটা মেয়ে হবে। সেই আশা তো এতদিন অপূর্ণই ছিল বলো? সুলচনা দেবী এমন একটা সুখবরে এতক্ষন বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল। কারণ এই মনের আশা তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন।তাঁর চোখেও এখন আনন্দাশ্রু।
সুলচনা দেবী বলতে থাকেন অমল বাবুকে- তোমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে কারোই তো মেয়ে স্বাদ পূর্ণ হলো না। একটা কন্যা সন্তানের জন্য তিন জা হাপিতেশ করে বুড়ি হয়ে গেলাম। কিন্তু ভগবান মুখ তুলে চাইলেন না। আজ এত গুলো বছর পর মা লক্ষী এসেছেন এই বংশে। - কি গো টুকাইয়ের বাবা, আমাদের বোলপুরের বাড়িতে ফোন করে দাদা বৌদি দের এখুনি সুখবর টা দাও।
এখুনি ফোন করছি।
--হ্যালো, দাদা? আমি আমল বলছি।
--হ্যাঁ বল। কিন্তু এত রাতে ... শরীর টোরির কারো খারাপ নাকি রে? কি হয়েছে?
--আরে সেসব কিছু না গো। সুখবর আছে। টুকাইয়ের মেয়ে হয়েছে।
-- সে কি রে!! ওগো শুনছো ওঠো তাড়াতাড়ি শাখ বাজাও, উলু দাও। টুকাইয়ের মেয়ে হয়েছে। আমাদের বংশে লক্ষীমা এসেছেন।
-- শঙ্খ, উলুর ধ্বনিতে বেজে উঠেছে আজ সেনগুপ্ত বাড়ির অন্দরমহল। ভোরের আলো ফোটা মাত্রই বংশের কুলো দেবীকে আরম্ভর করে পুজো শুরু হয়ে গেছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর যে, বংশে দেবীর আগমন ঘটেছে।
0 মন্তব্যসমূহ