সাঁওতালি মেয়ের সাহিত্য চর্চা
আমার তামাটে বর্ণ, গায়ে মেঠো গেঁয়ো গন্ধে অচেনা তিলোত্তমা কে দেখেছি বহুবার নাক সিটকোতে। আমার গ্রাম্য চলন ধরণ, তেলা চুলে লাল ফিতেয় আটা কলা বিনুনি দেখে তিলোত্তমা বাসীর মনে হাসির পাহাড় ফাটে।
ছোট্ট শালপুরীর মাতৃময়ী সদন বিদ্যালয়ের উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে প্রথম স্থানাধিকারী , আর গ্রামের মোড়ল সনাতন জেঠুর জমিতে বেগার খাটা সামান্য ভাগচাষীর মেয়ে আমি কানোনময়ী মুর্মু ।
শালপুরীর ছোট্ট একফালি খড়ের ছাউনি ঘরে ভোরের আলো প্রবেশ করার আগেই মা বেরিয়ে যেত কাজের সন্ধানে। ভোর ভোর আমিও বিছানা ছাড়তাম। হাঁস, মুরগি খোরক থেকে বার করে, বাসী উঠোনখানি ঝাঁট দিয়ে, গোবর জলে ঘর নিকিয়ে গা ধুয়ে যখন একবাটি মুড়ি আর খানিক চিনি নিয়ে দাওয়াতে বসতাম তখন সবে মাত্র সকাল ছয়টা।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এর বৈশিষ্ট্য, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন, কখনো মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠ এই নিয়েই কেটে যেত আমার প্রথম ধাপের সকাল। তারপর মায়ের হাতে হাতে কাজ করার জন্য মাঠে যেতে হতো। বেলায় তিনটে প্রাণীতে কাকভরে মায়ের রান্না ভাত, তরকারি যেদিন যা জুটত খেতাম। বেগার খাটা মানুষ দুটো মানে মা আর বাবা সন্ধে গড়ালেই বিছানা নিত। কারণ শারীরিক পরিশ্রম আর সায় দিত না জেগে থাকার। ঠিক এই মুহূর্ত গুলোতে আমি হারিয়ে যেতাম একান্তে আমিত্বে। স্বপ্ন বুনতাম বাংলা সাহিত্যে নিজের রাজত্ব গড়ার। বরাবর সাহিত্যকে আকড়ে বাঁচতে চেয়েছি। আর সেই তাগিদেই আমি তিলোত্তমায় পরে আছি ছয়টা বছর ব্যাপী।
মাতৃভাষা বলতে বাংলা সাহিত্য কেই আমি ব্যবহার করে এসেছি এই কলেজ জীবনে। সাঁওতালি ভাষা আমার অন্তরে আছে পোষা। সেটার যত্র তত্ৰ ব্যবহার করে নিজের তেলা চুলের বিনুনির মতো তাকে অপদস্ত হতে দিই নি এই শহুরে মানুষ গুলোর কাছে।
কাল আমার সাহিত্য জীবনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার দিন। এই ছয়টা বছরের কলেজ জীবন (গ্রাজুয়েশন, মাস্টার্স) ,আমার হোস্টেলে প্রতিমুহূর্তে অপমান,আর আমায় নিয়ে বিদ্রুপ করার রাত আজ যাবে ফুরিয়ে। দিন গোনা শেষ হবে এক অভাগী মায়ের। যে কিনা সমাজের কাছে গঞ্জনা, আর হাসি তামাশার খোরাক হয়েও আমায় পাঠিয়েছে আমার স্বপ্নকে ছুঁতে।
আমি জানি এই যুদ্ধে জয়ী আমি হবই। আমার জয়ের পথ কে আরো সুনিশ্চিত, আরো দৃঢ় করেছে গ্রামের কিছু ভ্রান্ত ধ্যানধারণায় বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ গনের কটাক্ষ মন্তব্য, আমার উচ্চ বিত্ত, আধুনিকতার ছাঁচে গড়া কিছু সহপাঠীর ঠাট্টার হাসি। এদের আমার প্রতি ঘৃণ্য দৃষ্টি আমার মনের ইচ্ছেটাকে আরো উদ্যম বাসনায় পরিণত করেছে।
আমার প্রাপের সবটুকু অর্জন করে আমি আবার ফিরে যাব ধামসা মাদলের পাগল করা ধ্বনি অনুধাবন করে লাল মাটির পথ ধরে আমার শালপুরী গ্রামটাতে। শিক্ষার আলোয় লাল সরানকে লালাভ করতে, আর শালপুরী কে শিক্ষার আঙ্গিকে রাঙিয়ে তুলতে।
ছবি : সংগৃহীত


3 মন্তব্যসমূহ
কি সুন্দর ভাষা য় ভাবের বিস্তার !!তুমি আবার ও প্রথম শ্রণীতে উত্তীর্ণ
উত্তরমুছুনসর্ব ক্ষেত্রে বিজয়ী হও
ধন্য বাদ বন্ধু।আমার অন্য পোস্ট গুলি পড়ার অনুরোধ রইলো।
মুছুনখুব সুন্দর।।😊😊
উত্তরমুছুন