কন্যা/ মেয়ে সন্তানকে বিয়ে দেওয়ার পর কি মা, বাবার তার ওপর আর কোনো অধিকার থাকে না? ( Rights of parents over daughter)

 




ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌমা নিয়ে এসে ছেলের বাবা , মা নিশ্চিন্ত হন। ( সবাই নয়। ব্যতিক্রম কিছু মানুষ আজ ও আছেন পৃথিবীতে আমি তাদের কথা বলছি। ভালো শশুর, শাশুড়ি এবং বউ মা র দৃষ্টান্ত ও আছে অনেক) তারা ভাবেন যে, এত কষ্ট করে ছেলে কে পড়াশোনা করিয়েছি, নিজেদের সব টুকু উপার্জন , পরিশ্রম সবটা খরচ করে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করিয়েছি । এবার ছেলের বউ এসে তাদের শুধু সেবা যত্ন করবে । তাদের দায়, বিপদে পাশে থাকবে। সংসারের সমস্ত কাজ করবে। হ্যা, এটা ঠিকই। যে কোনো মেয়েরই উচিত বিবাহের পর শশুর , শাশুড়ির খেয়াল রাখা। তাদের দায়, বিপদে পাশে থাকা। এ তো গেল ছেলে সন্তানদের মা বাবার চাহিদা, তাদের মনন চিন্তা। 


আর যারা মেয়ে সন্তানের মা বাবা? তাদের কথা ভেবেছেন কেউ তারা তো নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে, বয়স হয়ে গেলে অথর্ব হয়ে গেলে কে দেখবে কে করবে এই সব চিন্তা না করে  সন্তান কে অন্য ঘরে পাঠায়। তাদের তো মনন চিন্তায় এইরকম মনে হয় না যে, মেয়ে কে এত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছি। গান , বাজনা শিখিয়েছি।তিল তিল করে বড় করেছি তাহলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে একটা জামাই আনি বাড়িতে। যে তাদের সব দায় নেবে। না, তারা এইসব ভেবে বিয়ে দেয় না।


তনয়া র সবে একবছর হয়েছে বিয়ে হয়েছে। দেখাশোনা করে সন্মন্ধ করে বিয়ে। শশুর, শাশুড়ি ও বর এই নিয়ে তার সুখের সংসার। তনয়া গৃহবধূ। খুব শান্ত, ও ধৈর্য শীল মেয়ে। মুখে ফুটে নিজের মনের ইচ্ছে, অনিচ্ছা  গুলো কাউকে বলতে পারে না। কাউকে নিয়ে সমালোচনা করতেও পছন্দ করে না। বিয়ের আগে বন্ধু, বান্ধব দের কাছে শাশুড়ি , শশুর সম্পর্কের যে তিক্ততার কাহিনী শুনে সে মনে মনে খুব ভয় পেত, নিজের শাশুড়ির সাথে তার এইরকম কোনো তিক্ততার সম্পর্ক এখনো অবধি হয় নি। কিন্তু ও সবসময় আড়ষ্ট হয়ে থাকে এই শঙ্কায়, 

 পরিস্থিতি কখনো বদলে যাবে না তো! 


তনয়া দের একটা মেডিক্যাল শপ আছে। ব্যবসাটা তনয়ার বর আর শশুর একসঙ্গেই দেখেন। ওনারা সেই সকাল সাত টায় বেরিয়ে যায়। আর বাড়ি ফেরেন রাত দশ টায়। তনয়া কে তাই ভোরে উঠেই রান্না সেরে ফেলতে হয়। যদিও তনয়া র শশুড় মশাই দুপুরের খাবার টা বাড়িতে খেতে আসেন। কিন্তু তনয়া র বর সেই সকালে বেরিয়ে রাতে ফেরে। এই একবছর এর বিবাহিত জীবনে ওদের হানিমুনে যাওয়া হয় নি । পারিবারিক ব্যবসা তাই খুব ব্যস্ত। আর তনয়া ও  কোনো অভিযোগ করার মতো মেয়ে না। সবটাই মেনে নিয়েছে সে ।


কিন্তু বিগত এক সপ্তাহ যাবৎ তনয়া র মনটা খুব উতলা। অনেক দিন হল বাপের বাড়ি যায় নি। তার ওপর ও বাড়ি থেকে ফোন করেছিল ওর মা এর শরীর টাও কদিন ভালো যাচ্ছে না। তনয়া যদি দিন সাতেক এর জন্য ওখানে যেতে পারতো ওর মায়ের একটু ভালো লাগতো। ওর মা একটু রেস্ট পেত।


তনয়া র বাবার একটা ছোট্ট কাপড়ের দোকান। দোকান না বলে গুমটি বলাই ভালো। তনয়া ছোট থেকেই তার বাবাকে দেখে এসেছে সকাল থেকে রাত অবধি দোকানের জন্য পরিশ্রম করতে। কম্পিটিশন এর বাজারে বড় বড় দোকান গুলোর সাথে টেক্কা দিয়ে তার ছোট্ট ব্যবসা টাকে টিকিয়ে রেখেছে। মানুষ বড় বড় শপিং মলে গিয়ে এক দামে মানে ফিক্সড রেটে কেনা কাটা করতে পারে, কিন্তু ছোট দোকান দেখলেই দরকষাকষি করতে ইচ্ছা করে। কি নিদারুণ যুদ্ধ এই জগৎ সংসারে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত দের টিকে থাকার।। তনয়ার বাবা পরিমল বাবু তাই সংসারে বেশি সময় দিতে পারতেন না।


তনয়ার বয়স তখন বারো কি তেরো তখন থেকেই রেশন, মুদি খানা, বাজার দোকান তাকেই করতে হত। আরো একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে পোস্ট অফিস এর কাজ ব্যাংকের কাজ সেগুলো ও যুক্ত হলো। এই ভাবে তনয়া মাধ্যমিকে র গন্ডি পেরোলো। এবার সংসারের বোঝা বাবার থেকে একটু কমিয়ে নিজে কিছু টিউশনি পড়িয়ে নিজের রোজগারের টাকায় নিজের পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে থাকলো। এই ভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলো। এই সময় তনয়া ওর বাবার দোকান ও টুকটাক সামলাত। পাশাপাশি মায়ের হাতাহাতি কাজ করতেও। তনয়া কোথাও একটা ওর মায়ের মধ্যেয়েই ওর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেত। ওর মা যেমন গৃহবধূ হয়ে ছোট্ট সংসার টাকে রাজপ্রাসাদ এর মত সাজিয়ে রাখতো ওর ও মনের শখ ছিল ওর ও সংসার টাকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবে। সংসারের সকল সদস্যদের দেখ ভাল করবে। একটা সুখী সংসার যাকে বলে।


তনয়া খুবই ভাগ্যবতী। ও নিজের মনের মতো সংসার ও পেয়েছে। কিনতু তনয়া ভেবেছিল কয়দিন বাপের বাড়ি থেকে আসবে। যে কদিন ওখানে থাকবে মাকে কোনো রান্না বান্না বাড়ির কাজ করতে দেবে না। এতে মায়ের শরীর টা একটু রেস্ট পাবে। সেই মতো তনয়া শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে অনুমতিও চেয়েছিল । শাশুড়ি মা বলেছিলেন আগামী সোম বার দিন যেতে। কিন্তু দুর্ঘটনা টি ঘটে গত শনিবারই। তনয়ার শাশুড়ি বিকেলে হাট তে বেরন । এই সময় একটি অটোর সাথে ওনার একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাচক্রে তনয়ার শাশুড়ির পায়ে চোট লাগে। তাই এই দুদিন শাশুড়ি মাকে নিয়ে তারা সবাই খুব ব্যস্ত । পায়ে ব্যান্ডেজ করা আছে। ডাক্তার ওনাকে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট নিতে বলেছেন। এইদিকে বাপের বাড়ি তে তনয়ার মায়ের জন্য ও মনটা ছটফট করছে। তনয়া সব টা বুকে চেপে রেখেই শাশুড়ির সেবায় মন দেয়।


সকাল বেলা শাশুড়ির ঘরে চা দিতে আসে তনয়া। শাশুড়ি মা তনয়া কে বলে , তোমার তো আজ বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বৌমা। তনয়া খানিক টা চমকে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে, যেতাম তো। কিন্তু আপনারও তো হটাৎ করে পা টা....

তনয়ার কথার রেশ টেনে উনি বললেন, আমায় দেখার জন্য আমার সন্তান আছে বৌমা। এমনতো নয় যে, এই রকম বিপদ এই প্রথম ঘটলো এই বাড়িতে। এর আগেও তো কত ঝড় ঝাপটা গেছে। তখন তো তুমি ছিলে না। মা, বাবার দায়ে বিপদে সন্তানরা তাদের পাশে থাকবে এই আশা ই তো সব সন্তানদের মা , বাবা করেন। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও। তুমিও তো তোমার মা, বাবার সন্তান। তুমি বিবাহ এর বাঁধনে বেঁধে আমাদের আপন করে নিয়েছ। তোমার কাছথেকে  আমরা দিনের পর দিন সুবিধা নিচ্ছি। আর তোমার বাবা, মায়ের বিপদে যদি আমি তোমায় এই ভাবে আটকে রাখি এটা তো পাপ। তুমি ও বাড়ি থেকে ঘুরে এসো বৌমা। আমার ছেলে ততদিন দোকান এ বেশি টাইম না দিয়ে আমার কাছে থাকবে। রান্না বান্না করবে। ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। 


- মা, আপনার ছেলে রান্না বান্না....

- হ্যা, সব পারে বৌমা । আমার ছেলেকে আমি সবটাই শিখিয়েছি। যাতে এই দিন গুলোতে কোনো অসুবিধা য় কাউকে না পড়তে হয়। বৌমা, বেলা হয়ে গেল। তুমি যাও স্নান সেরে রেডি হয়ে নাও। আমি বাবু কে বলছি ফোন করে তোমায় দিয়ে আসতে।


তনয়ার চোখে এখন নোনা জলধারা টা খুশির ছলে টলমল গতিতে গাল ছাপিয়ে চিবুক ছুঁয়েছে। 


কিছুক্ষন পরেই বাইকের হর্ন এর শব্দে তনয়া জানলা দিয়ে উকি দিয়ে দেখলো বর মশাই বাড়ি এলেন।

- এখনো রেডি হও নি তনয়া?

- এই তো রেডি । দাঁড়াও একবার মায়ের সাথে দেখা করে আসি।

শাশুড়ি মাকে প্রণাম করতে ঘরে ঢুকলো তনয়া। মানুষটাকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে তনয়া।এ যেন এক নতুন প্রজন্মের দেবী। ঘর আলো করে আছে তার সামনে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই বুকে টেনে নিয়ে বললেন, আসলে কি বলো তো বৌমা, সন্তান তার মায়ের কাছে সন্তানই হয়। সে ছেলেই হোক কিংবা মেয়ে। আমার অসময়ে যেমন আমার ছেলে থাকবে তোমার মা,  বাবার দায় বিপদে তোমাকেই তো থাকতে হবে মা। তুমি, বাবু একসাথে আমাদের অসময়ে, তোমার মা বাবার বিপদে থাকবে।  চিরাচরিত মন গড়া সংস্কার ছেড়ে এবার আমাদের বেরোতে হবে। তবেই তো সমাজ আরো উন্নত হবে। নারীকে সবাই সন্মান করবে। মেয়ে সন্তানদের কদর করবে।

মেয়ে সন্তানদের মা, বাবারও অধিকার আছে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পরেও তাদের সেবা , যত্ন পাওয়ার মেয়ের থেকে। জামাই এর থেকে। 


আজকের সকাল টা অন্য সব গুলো দিনের থেকে একদম অন্যরকম সকাল তনয়ার জীবনে। খুশিতে আনন্দে বার বার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসছে। কাজল যাচ্ছে লেপ্টে, তবুও আয়নার সামনে এসে দেখলো তনয়া তার মুখ টা কি অসাধারণ সুন্দর লাগছে। আমায় এত সুন্দর দেখতে! নিজের মুখের আদল দেখে নিজেই অজান্তে বলে ফেলে তনয়া। তনয়ার মনে পড়ে যায় মানুষ ঠিকই বলে আনন্দে থাকলে, খুশিতে থাকলে মানুষের রূপ ভিতর থেকে উজ্জল হয়ে ওঠে। তনয়া ভগবান কে বলে তুমি প্রতিটা ঘরে ঘরে এই রকম দেবীর মতো শাশুড়ি মা দিও ভগবান। 




আজকে এই পর্যন্তই আবার আসবো আগামী কাল। সকলে ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।


ছবি : সংগৃহীত




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ