অনিমেষ বাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর মৌলি দেবী আবার বিছানা নিয়েছিলেন। মৌলি কে কারণে অকারণে অপমান করাটা অনিমেষ বাবুর একটা স্বভাব। এটা নিত্য দিন হয়েই থাকে। অনিমেষ বাবু বেরিয়ে যাওয়ার পরই মিঠু এসে মৌলি দেবীর কাছে এসে বসে। তাকে সান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা বা অধিকার তার নেই বটে, কিন্তু মৌলিদেবীর এই ভারাক্রান্ত এর সময় মিঠু সবসময় তার পাশে থাকে। আর মৌলিদেবীও মিঠু কে খুব ভরসা করে। আর ভালোবাসে মিঠুর ছেলে সূর্যকেও। সূর্য ও তার মায়ের মতোই মৌলিদেবী কে ভীষণ ভালো বসে। সূর্য মৌলি দেবী কে মণি মা বলে ডাকে।
সেই জন্যই সূর্য বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই মণি মা.... মণি মা ....করে ডেকে বাড়ি মাথায় করে তুলেছে।
সূর্যের গলা পেয়ে মৌলিদেবী ধরফর করে উঠে বসলেন। নোনা জলের ধারাটা আঁচলে মুছে .... সূর্য যে ! দু-দিন যে আসিস নি বড়ো? তোর মণি মা কে বুঝিস ভুলে গেছিস?
-কি যে বলেন দিদি । আপনি হলেন সূর্যের সাক্ষাৎ দেবী মা। আমি ওর মা। আমায় ও ভুলে যেতে পারে, কিন্তু দিদি আপনাকে কোনো দিন কি ও ভুলতে পারবে? না পারবে আপনার ঋণ শোধ করতে! আপনি না পাশে দাঁড়ালে আমার সূর্যের কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন টা স্বপ্নই থেকে যেত। ভর্তির টাকা, বইপত্র কেনার টাকা, মাসিক টাকা সব তো আপনিই দিচ্ছেন। তাও দাদাবাবু কে আড়াল করে। দাদাবাবু জানলে কি যে বড় বিপদ হবে কি জানি.... ভাবলেই আমার গা শিউরে ওঠে। ( মিঠু )
- কি যে বলিস মিঠু, সূর্য যে আমার নয়নের মণি। আর আমার মেয়ে শ্রীজা যে আমার কলিজার টুকরো রে। এদের কোনোদিন কি আমি আলাদা চোখে দেখেছি কখনো ? ( মৌলিদেবী )
দুজনের কথোপকথন শুনে সূর্য খানিক লজ্জা পেয়ে নতমোস্তকে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।
- ও মিঠু, হা করে বসে কি করছিস? কাল যে দুজন মিলে নারকেল নাড়ু বানিয়েছিলাম। সে গুলো সূর্য কে দে। আমার সূর্য যে নারকেল নাড়ু খেতে বড্ড ভালোবাসে।
- দিদি আপনার এই আদুরে পনার জন্যই ছেলেটা বড্ড বেশি ছচা হয়ে গেছে। ( মিঠু )
-যা! কি যে বলিস না! আমার সূর্য যে এখন ও সেই ছোট টিই আছে। আমার শ্রীজা মায়ের মতো।
কথা বলতে বলতেই মিঠু খান ছয়েক নাড়ু সূর্যের হাতে দিল।
এক কামড় মুখে দিয়ে সূর্য তৃপ্তি করে নাড়ু চোখ বুজে খেতে লাগলো।
- কেমন হয়েছে রে সূর্য?
- উমমম .... দারুন .... যাকে বলে অমৃত। এতে আমার মণি মা এর ছোঁয়া আছে কিনা .... ( সূর্য )
-ওহ ! আর নিজের মায়ের হাতের ছোঁয়া রান্না বুঝি ভালো লাগে না? ( মিঠু)
- দেখলে, মণি মা, দেখলে .... এক মায়ের প্রশংসা করলে অমনি আর এক জন এর রাগ হয়ে যায়। (সূর্য মা কে জড়িয়ে ধরে) তুমি তো আমার সোনা মা। এত আদর যত্নে কষ্ট করে তিল তিল করে আমায় মানুষ করছো তোমার ঋণ কি কখনো শোধ করা সম্ভব? তোমরা দুজন ই আমার কাছে সাক্ষাৎ দেবী।
- আচ্ছা অনেক ক্ষণ ধরে অনেক আদর খাওয়া হলো। বল দেখি কি জন্য এখন এসেছিস? কলেজ যাস নি?
- বা... রে ! কলেজ তো আজ ছুটি। সরকারি ছুটি। তোমায় তো সকালেই বললাম।
তাহলে শ্রীজা যে কলেজ বেরোলো? তাহলে ও কলেজ বেরোনোর নাম করে গেল কোথায়? - আশ্চর্য হয়ে মৌলিদেবী বললেন।
মিঠু ও সূর্য বেশ অপ্রস্তুত তে পরে গেল।
আসলে সূর্য এইভাবে শ্রীজা কে ফাঁসাতে চায় নি। ও তো আর জানতো না শ্রীজা বাড়িতে নেই। বরঞ্চ শ্রীজাকে এক ঝলক দেখার তাড়না তেই ওর এখানে আসা।
অবশ্য এটা শ্রীজার স্বভাবের কোনো নতুনত্বের ব্যাপার নয়। ও প্রায়ই গাড়ি নিয়ে বন্ধু বান্ধবী দের সাথে ঘুরতে যায়, সিনেমা যায়, ডিস্কো তে যায়।
খুবই শৃঙ্খলাহীন জীবন যাপন করে। বাবার মতো ওর ও শরীরের ভিতরটা আত্ম অহংকার এ পরিপূর্ণ। বড় লোকি মেজাজ এ চলতে ভালোবাসে। গরিব লোকেদের পাত্তা দেয় না। তাদের দেখলে হাসি, ঠাট্টা করে। বাড়ির কাজের লোক দের ও মেজাজ দেখায়। মিনিটে মিনিটে হুকুম করে। কিন্তু একমাত্র মিঠু কেই সে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। কষ্ট হলে মায়ের কাছে নয়,মিঠু পিসির কোলেই মুখ গোজে। শ্রীজার মা শ্রীজাকে আত্মঅহংকারী ,তার বরের মতো মেয়েকেও মেজাজি, জেদি মনে করলেও, একমাত্র মিঠু পিসি জানে শ্রীজার শক্ত , কঠোর রাফ- সাফ কথা র ভিতরেও কষ্টের কথা আছে, মনের দুঃখ আছে। একটা আবেগী মন আছে, কোমল হৃদয় আছে। মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ আছে, অভিমান আছে। এই সব কিছুকে ভুলে থাকতেই তার এই বোহেমিয়ান জীবন।
ছোট থেকেই কিন্তু শ্রীজা এইরকম ছিল না।
সূর্য আর শ্রীজা একই বয়সী। ছোটবেলায় শ্রীজার একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিল সূর্য। দুজন এর খুব মিলমিশ ও ছিল। শ্রীজা জন্মদিনে যা যা গিফট পেত তা থেকে ওর যেগুলো সব থেকে প্রিয় সেগুলো ও নির্দ্বিধায় সূর্য কে দিয়ে দিত।
সূর্য বলতো এই গুলো তো সব তোমার পছন্দের খেলনা শ্রীজা। এইগুলো তোমার কাছেই রাখো।
শ্রীজা বলতো আমার সব ভাললাগা র জিনিস আমি তোমায় দিতে পারি। আমি আর তুমি কি আলাদা নাকি?
সূর্য আর শ্রীজা ছোট থেকেই একে অপরকে খুব পছন্দ করতো।
দুজন এর মধ্যে মারপিট ও কম হতো না। খেলতে খেলতে দুজন দুজন এর চুলের মুঠি ধরে মারতো ও। কখনো শ্রীজা কেঁদে ফেললে সূর্য ওকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরতো। আদর করতো। শ্রীজা কাঁদলে সূর্য নিজের ভুল টা বুঝতে পারত। শ্রীজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো আর কখনো এইরকম করবো না শ্রীজা। আমার ভুল হয়ে গেছে। তোমার খুব লেগেছে তাই না শ্রীজা? শ্রীজা তখন সূর্য কে আকড়ে ধরে আরো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো। এই কান্নার মধ্যে কোনো ব্যথার আঘাত ছিল না। ছিল নিষ্পাপ ভালোবাসার পরিপ্রকাশ।
কিন্তু সেই ছোট্ট শ্রীজা আজ অনেক বদলে গেছে। ছোট বেলার মতো সূর্য কে আর ও চোখে হারায় না। বরঞ্চ সূর্যের জন্য তার মনের গভীরে জন্মেছে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা। সূর্যকে ও বিশ্বাসঘাতক ভাবে। কিন্তু সূর্য জানে ও নির্দোষ। কিন্তু তার প্রমান করার কোনো উপায় তখন ওর ছিল না।
চলবে .....
0 মন্তব্যসমূহ