এখন দুইজন এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওদের পরিস্থিতি। এই পরিস্হিতি সামাজিক, পারিবারিক, সর্বোপরি একটা পরিণত মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসার পরিস্থিতি। কিন্তু অরিন এর যে কিছু করার নেই। অনেক চেষ্টা করার পরও ও একটা সরকারি চাকরি জোটাতে পারছে না।
সেই কোন ছোটবেলা থেকে ওদের ভালোবাসা। তখন বোধ হয় ভালোবাসি কথাটার সাথেও ওরা এত পরিচিত ছিল না। শুধু জানতো ওরা পরস্পর পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব ই কখন যে ওদের অজান্তে এত কাছাকাছি নিয়ে এসেছে ওরা বুঝতে পারে নি। তিথি এখনো অরিন কে ঠিক ঐভাবেই ভালোবাসে। অরিন ও তাই। কিন্তু অরিন একটা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত তিথির বাড়ি থেকে কখনোই অরিন কে মেনে নেবে না। আর একটা ২৫ পেরোনো অবিবাহিতা মেয়ের পক্ষে পারিবারিক সামাজিক লাঞ্ছনা, ভৎসনা শোনা যে কতটা দুর্বিষহ তা অনেকেই জানে।
যদিও তিথি এই সব এর কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করে না। ওর একটা বিষয়েই অরিন এর সাথে মতের পার্থক্য তা হলো অরিন শুধু সরকারি চাকরির পিছনেই দৌড়াচ্ছে। তিথির বক্তব্য এখন বেসরকারি ও কত নামি দামি উন্নত কোম্পানি আছে । ও সেখানেও একটা জব এর জন্য আবেদন করতে পারে। এত দিনের ভালোবাসাকে পরিণতি দেওয়ার জন্য ই তিথির এত প্রচেষ্টা। সেই টাকেই অরিন মাঝে মাঝে বলে তিথি তুমি কিন্তু দেখছি বিয়ে পাগল হয়ে গেছ।।
প্রথম প্রথম অরিন এর মুখে এই কথা শুনে তিথির লজ্জা লাগলেও এখন খুব রাগ হয়। সেই নিয়েই চলছিল আজ রাগারাগি।
তিথি টিউশন পরিয়ে ফিরে প্রতি রবি বার এই গঙ্গার ধারে আসে অরিন এর সাথে দেখা করতে। সেই কলেজ লাইফ থেকে অর্থাৎ যখন থেকে ওরা বুঝতে পেরেছে এটা আসলে শুধু বন্ধুত্বই নয় মন থেকে ভালোবাসা তখন থেকেই ওরা এখানে আসে , গল্প করে। নিজেদের মতো একটু সময় কাটায়।
অরিন ছেলেটাও খুব ভদ্র। পড়াশোনায় খুবই ভালো। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে এখনো একটাও ভালো চাকরি সে পায় নি। আসলে অরিন সরকারি ছাড়া কোনো বেসরকারি চাকরিতে আবেদন ই করে নি। অরিন দেরও মধ্যবিত্ত পরিবার। তিথি দের ও তাই। দুই বাড়ি থেকেই ওদের সম্পর্কের কথা সবাই জানে। এমনকি দুই পক্ষের কিছু কিছু আত্মীয় স্বজন ও জানে। তারাই কেউ কেউ কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে তিথিকে দেখে বলে - কি রে বয়স তো কম হলো না। তা বন্ধুকে এবার বিয়েটা করে নিলেই তো হয়। আর কত দিন লুকিয়ে চুরিয়ে ঘুরবি বাপু।
এইসব পাতি কথায় পাত্তা না দিলেও তিথির ও ওসব কথা শুনে একা রাতের নিরালায় মনে হয়, সত্যিই এবার বিয়েটা করে নেওয়াই ভালো। ভালোবাসা থাকলে সবাই চায় সেই সম্পর্ক পরিণতি পাক। আর এই বিষয়ে মেয়ে দেরই হয়তো বেশি মনে হয়। তাই জন্যই কদিন ধরে তিথি চাপ দিচ্ছিল অরিন কে একটা অন্তত বেসরকারি চাকরি ও করুক। তারপর না হয় পরীক্ষা দিতে দিতে যখন সরকারি চাকরি পেয়ে যাবে তখন ছেড়ে দেবে বেসরকারী চাকরি। বার বার তিথির কাছ থেকে এ কথা শুনে অরিন আজকাল প্রায় ই আহত মনে বাড়ি ফিরছিল।
একলা রাতে বারবার বুকের ভিতর টা উতাল পাতাল করে উঠতো।
- সরকারি চাকরি আমার স্বপ্ন, সেটার জন্য আমি এত পরিশ্রম করছি, এত খাটছি তিথি কি আর কটা দিন আমায় সময় দিতে পারে না!
বার বার নিজের ভালোবাসার কাছ থেকে আঘাত পেয়ে অরিন এর স্বপ্ন গুলো চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু অরিন এরও ভাবা উচিত একবার তিথির কথা গুলো। ওর বয়সী সব বান্ধবী দের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শুধু তো বিয়ে নয়। যে যেন জীবন যুদ্ধে জিতে যাওয়ার ইচ্ছা। এই যুদ্ধে যে তিথি জিতে সকলকে দেখিয়ে দিতে চায় অরিন তাকেই ভালোবাসে , তাই তাকেই বিয়ে করেছে। তাই জন্য এত চাপ দিচ্ছে তিথি।
সেই মান - অভিমান এর কথাই আজ ও হচ্ছিল গঙ্গা বক্ষে।
চলছিল বলা না বলা অনেক কথা। যা নীরবেই দুজন দুজনকে বলছে।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে , চারিদিক কৃত্তিম আলোয় সেজে উঠেছে, গঙ্গার সংলগ্ন এলাকা। নৌকা গুলো সব পরস্পর ঘাটে বাধা। ওদের পাশ দিয়ে একটা বছর পনেরোর ছেলে বাদাম...বাদাম হাক দিয়ে ওদের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল। গঙ্গা এখন শান্ত। চিক চিক করছে আলোয় জল গুলো।
তিথির চোখের কোনেও তখন চিক চিক করছে অভিমানী চোখের জল।
অরিন পিছন থেকে আর একবার ওর হাত টা স্পর্শ করল। তিথি আর তখনকার মতো রাগ দেখালো না। রাগ গুলো এখন ঝরে যে অভিমানে পূর্ণতা পেয়েছে।
অরিন এবার সাহস পেয়ে হাতটা চেপে ধরতেই তিথি নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। অরিন এর কাঁধে মুখ নিচু করে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
ধরা গলায় তিথিকে আগলে ধরে অরিন বললো পাগলী তোমার জন্য আমি সব ই করতে পারি। সরকারি চাকরি যেমন আমার স্বপ্ন। তোমায় নিজের করে পাওয়াটাও আমার সব থেকে বড় স্বপ্ন। আমি আমার কোনো স্বপ্নই চুরমার হতে দেব না।
তিথি কাঁধ থেকে মুখ সরিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো... মানে?
.... মানে টা খুব সোজা মিস তিথি। আসলে আজই আমি সরকারি চাকরির জয়েনিং লেটার পেয়ে গেছি।
তিথি কথা গুলো শুনে যেন নিজের কান কেই নিজে বিশ্বাস করতে পারছিল। চোখ দিয়ে অভিমান এর জল সরিয়ে আনন্দের জল গড়িয়ে পরলো।
-ন্যাকা ছেলে একটা !
-এখনো তুমি আমায় ন্যাকা বলছো?
-হ্যা বলছি
-কেন
-এটা আমায় আগে বলো নি কেন?
-তোমায় একটু রাগাছিলাম।
দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে এই ভালো লাগা টুকু কিছুক্ষণ ওরা উপভোগ করলো।
তারপর রওনা দিলো ভালোবাসার পরিণতির দিন গুনতে গুনতে।
সমাপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ