ভালোবাসি তোমায়
বাবাই দা, সকালে তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম তোমার মা, মানে কাকিমা বললেন, তুমি নাকি কাল ই চলে যাচ্ছ কলকাতায়?
- হ্যা রে, প্রিয়া। বাবা কে বারবার করে বলছি যাবো না। তবু বাবা কথা শুনতে নারাজ। তুই তো জানিস ই আমাদের অৰ্থিক অবস্থার ব্যাপারে সব কিছু। কোথা থেকে বাবা আমার পড়াশোনার জন্য ওতো টাকা জোগাড় করবে কি জানি!
- তুমি ওতো ভেঙে পরো না বাবাই দা। তোমার মত এত ব্রেনি ছেলে রাই তো পড়াশোনা করে দেশের নাম উজ্জ্বল করে।
- ছাড় তো। ওসব ব্রেন, ট্রেন কিছু নয়। টাকা টাই সব বুঝলি। এই জগতে টাকাই সব। যার টাকা আছে তার আর ভাবনা কিসের। আমার মতো দিন মজুর বাবার ছেলে যতই পড়াশোনায় ভালো হোক না কেন টাকা না থাকলে কিছুই হবে না। এই স্কুল পাশ করেছি এই ঢের হয়েছে। এবার লেগে পড়ি পাড়ায় ছেলে- মেয়ে পড়াতে, আর বাকীটা সময় মাঠে কাজ করতে।
প্রিয়া ঠোঁট উল্টিয়ে বললো , ঐরকম বোলো না বাবাই দা।
বাবাই হেসে বলে তোর আর কিসের চিন্তা রে প্রিয়া তোর বাবা তো এই গ্রামের মহাজন। তোর তো জাক জোমক ভাবে বড়ো লোক বাড়িতে বিয়ে হয়ে যাবে।
প্রিযা ছল ছল চোখে অভিমানি গলায় বলল, তুমি এত বড় কথাটা বলতে পারলে বাবাই দা?
তাহলে তোমার সাথে যে আমার ছোট থেকে যে সম্পর্ক সব টাই মিথ্যে? আমি তো তোমার মাকে মুখে কাকিমা বলি কিন্তু মন থেকে মানি উনি আমার মা।
সেসব হয় না রে প্রিয়া। ছোট বেলাকার স্মৃতি গুলো নিয়ে আকড়ে বসে থাকিস না। তখন আমরা দুজনেই বেশ ছোট ছিলাম। পুতুল খেলার ছলে হয়তো আমি তোর পুতুলের বাবা হতাম, আর তুই মা, - কিন্তু সেসব ছোটবেলাতেই মানায়। বাস্তবে তা সম্ভব নয়।
তুমি আমার চোখের দিকে চেয়ে বলো বাবাই দা আমি যদি বাবার দেখাশোনা করা ছেলেকে বিয়ে করি তুমি খুশি হতে পারবে তো? মেনে নিতে পারবে তো?
গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটা কোনো মতে সংবরণ করে বাবাই বললো, কেন পারবো না, তুই সুখে থাকবি তোর সংসারে কোনো অভাব থাকবে না। এতে আমার না খুশি হওয়ার কি আছে?
প্রিয়া জোর করে বাবাই এর হাত টা টেনে নিয়ে গিয়ে পাড়ার একটা বট গাছের তলায় এসে বসলো।
কি করছিস কি প্রিয়া, ছাড় ... এখুনি কেউ দেখে ফেলবে।
দেখলো তো ভারী বয়েই গেল ।
বাবাই এর হাত দু খানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে প্রিয়া , বাবাই এর চোখে চোখ রেখে বললো, কাল যে কলকাতায় যাচ্ছ, তোমার পড়া শেষ হতে কতদিন লাগবে?
- তিন বছর তো লাগবেই?
- তি... ন বছর....!
- হ্যা , তা তো লাগবেই।
- তিন বছর পর তুমি চাকরি পেয়ে যাবে?
- তা, তো আশা করাই যায়।
- বেশ আমি তিন বছর তোমার অপেক্ষা তেই থাকবো। তুমি কিন্তু আমায় ভুলে যেও না বাবাই দা।
বাবাই পুরুষ হয়েও নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। প্রিয়া কে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমায় কেন এত মন দিয়ে ভালোবাসলি পাগলী? আমি তো তোকে কিছুই দিতে পারব না রে কষ্ট, দারিদ্র, অভাব ছাড়া। তোরা কত বড় লোক।আমি কি তোকে তেমন করে রাখতে পারবো?
- খুব পারবে বাবাই দা। তুমিইও তো বড় লোক ।তোমার বড় একটা মন আছে। আমায় শুধু সেখানেই একটু জায়গা দাও তাহলেই আমি খুশি। আচ্ছা অনেক বেলা হয়েছে বাবাই দা বাড়ি গিয়ে জামা, পত্তর, বই , দরকারী কাগজ পত্র সব গুছিয়ে নাও। কাল আবার ভোর ভোর তোমায় বেরোতে হবে।
এরপর কেটে গেছে তিন তিনটে বছর। এর মাঝে বাবাই মাঝে মাঝে এসেছে। প্রিয়ার সাথে দেখাও হয়েছে। কলকাতায় থাকা কালীন চিঠিও পাঠাত নিয়ম করে। কলকাতায় পড়াশোনার অনেক খরচ। সব টা বাবাই এর বাবা দিয়ে উঠতে পারতো না। বাবাই টিউশন খেটে, নাইট এ হোটেলে বেয়ারার কাজ করে পড়ার টাকা জোগাড় করেছে। আজ তিন বছর পর চাকরি পেয়ে বাবাই ফিরে আসছে মা, বাবা কে সুখবর টা দিতে। দূর থেকেই দেখতে পেলো প্রিয়া আগে থেকেই খবর পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বট গাছের তলায়। সামনাসামনি আসতেই দুজনেই দুজনকে দেখে কেঁদে ফেললো, কিন্তু দুজনেরই মুখে জয় এর হাসি।
প্রিয়া, প্রিয়া .... আমি পেরেছি। আমি পেরেছি। আমি হেরে যাই নি। আমি চাকরিটা পেয়ে গেছি। আর তোকে আমার হারানোর কোনো ভয় নেই।
প্রিয়া ছুটে এসে বাবাই কে জড়িয়ে ধরলো।
এইদেখ প্রিয়া , তোর জন্য কি এনেছি...
চোখের জল মুছে প্রিয়া বললো কি এনেছ?
ছোটবেলায় তুই একবার আমার কাছে বায়না করে ছিলিস মেলায় গিয়ে কাচের চুড়ি কিনে দেওয়ার জন্য। তখন পারি নি । আজ এনেছি।
- আয়, তোকে পরিয়ে দি ই। হয়তো কম দামের জিনিস কিন্তু আমার পছন্দ হলো তাই তোর জন্য আনলাম। তোর পছন্দ হয়েছে?
ঝর ঝর করে আরো একবার কেঁদে প্রিয়া বললো খুব পছন্দ হয়েছে বাবাই দা। তুমি যে আমার ছোটবেলাকার কথা মনে রেখে কিনে এনেছ আমি খুব খুশি, এ যে আমার অমূল্য রতন, আমি সারাজীবন আগলে রাখবো। ভেঙে যেতে দেব না , আমাদের সম্পর্কের মতন।
বাবাই দা প্রিয়া র কপালে চুমু এঁকে বললো আমি জানতাম তোর পছন্দ হবে। খুব ভালোবাসি রে তোকে,এই তিনটে বছর খুব মিস করেছি তোকে।
ঠোঁটের কোণে আলগা লজ্জামাখা হাসি হেসে বাবাই দার বুকে মাথা রেখে প্রিয়া বললো, আমি ও খুব ভালোবাসি তোমায়।
সমাপ্ত
0 মন্তব্যসমূহ